উৎকোচ-নীতি-নৈতিকতা-দুর্নীতি  : মলয় রায়চৌধুরী

এক

আমি : আরে মুর্শিদ, হাওয়া৪৯-এর সম্পাদক, বলেছেন উৎকোচ-নীতি-নৈতিকতা-দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে একটা লেখা দিতে ।

বন্ধুনি : দিয়ে দিন । সিঙ্গাপুরে দুর্নীতি নেই বললেই চলে । কেন ? কারণ দুর্নীতির প্রমাণ পেলেই তার পোঁদে বাঁশ করে দেয়া হয়, তা লোকটা যতো বড়োই হোক না কেন । সিঙ্গাপুরের তুলনায় ভারতবর্ষে, বাঁশ প্রচুর হয়, কিন্তু কারোর পোঁদে বাঁশ করা হয়েছে বলে তো শুনিনি । চীনও অমন ব্যবস্হা নিচ্ছে । চীনা কমিউনিস্ট পার্টির উনিশতম কংগ্রেসে  প্রেসিডেন্ট ও পার্টির সাধারণ সম্পাদক সি চিন পিং দুর্নীতির বাঘ, মাছি ও শিয়ালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার   কথা বলেছেন। দুর্নীতির বিষয়ে বিন্দুমাত্র ছাড়া না দেওয়ার ঘোষণা করে উনি বলেছেন, ‘আমরা নামকাওয়াস্তে আনুষ্ঠানিকতা, আমলাতান্ত্রিক মনোভাব, আত্মপরতা, বিলাসিতা ও সুবিধালাভের চেষ্টার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি। কোথাও কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কারও প্রতি বিন্দুমাত্র সহিষ্ণুতা দেখানো হচ্ছে না। বাঘ, মাছি, শিয়াল—সবার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।’ ওদের দেশে তো গুলি করে মারা হচ্ছে । 

আমি : যতো দিন যাচ্ছে আমাদের দেশে দুর্নীতি ততো বাড়ছে । 

বন্ধুনি : দুর্নীতি মাপবার একটা সূচক আছে, জানেন নিশ্চয়ই : যাকে বলে সিপিআই।  এমন একটা সূচক যা বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন আর মতামত সমীক্ষা করে  সরকারী ক্ষেত্রে দুর্নীতির ধারণা স্তর অনুসারে  দেশগুলোকে নম্বর দেয়৷ সিপিআই সাধারণত দুর্নীতি মানে, “ব্যক্তিগত লাভের জন্য  ক্ষমতার অপব্যবহার” হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ১৯৯৫ সাল থেকে বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল  প্রতি বছর এই সূচক প্রকাশ করে । ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের সিপিআই, সেই অনুযায়ী ১০০ বা খুব স্বচ্ছ থেকে ০ অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত” স্কেলে ১৮০টি দেশকে র‍্যাঙ্ক করা হয়েছে । ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর আর সুইডেন বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে, তারা ক্রমাগতভাবে উচ্চ র‍্যাঙ্কিং করে। আর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলি হল সিরিয়া, সোমালিয়া আর দক্ষিণ সুদান, ২০২১ সালে এদের স্কোর ১০০ এর মধ্যে ছিল যথাক্রমে ১৩, ১১ আর ১১। ভারতের তলার দিকেই, ৭৮ নম্বরে ।

আমি : ভালো বলেছিস । কতো রকমের দূর্নীতি আর তার সঙ্গে যুক্ত মানুষ আছে, জানলে অবাক হবার বদলে ভয় করে : চোরচোট্টা গাঁটকাটা বাটপাড় ঘুষখোর কালোবাজারি দালাল সাট্টাবাজ কারচুপিকারী প্রতারক মালপাচারি ,  কাটমানি, কালোবাজার, কালোটাকা, ঘুষ, নজরানা, উৎকোচ, হাওয়ালা, স্মাগলিঙ, গরু পাচার, কয়লা পাচার, মেয়ে পাচার, গণধর্ষণ, ডাকাতি, খুন, তহবিল তছরূপ, ভর্তি কেলেঙ্কারি, নারদা, সারদা,  কর্পোরেট কেলেঙ্কারি, জালিয়াতি, নোটনকল, রোজভ্যালি, চাকরি বিক্রি, দলিল কারচুপি, জিপ কেলেঙ্কারি, এলআইসি কেলেঙ্কারি, বেনামি সম্পত্তি, টেলিকম কেলেঙ্কারি, এইচডিডব্লিউ সাবমেরিন কেলেঙ্কারি, জেএমএম ঘুষ কেলেঙ্কারি, তানসি ল্যান্ড ডিল কেলেঙ্কারি, বিটুমেন কেলেঙ্কারি, ইউরিয়া কেলেঙ্কারি, লটারি কেলেঙ্কারি, অনন্তনাগ পরিবহন সাবসিডি কেলেঙ্কারি, তেলগি স্ট্যাম্প পেপার কেলেঙ্কারি, তোলাবাজি, সিন্ডিকেট, নির্বাচনে টিকিট বিক্রি, জোচ্চুরি, কাজের বরাত, নদীতটের বালি বিক্রি,  পনজিস্কিম কেলেঙ্কারি, চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারি, ফাটকা জোচ্চুরি,  কালোটাকা সাদা করা, সাংবাদিক হত্যা, শেল কোম্পানি, সত্যম কেলেঙ্কারি, কমনওয়েল্থ গেমস কেলেঙ্কারি, মাদক পাচার, জাল ওষুধ বিক্রি, ব্যাপম কেলেঙ্কারি, আদর্শ হাউসিঙ কেলেঙ্কারি, কার্টেল, সুইসব্যাঙ্কে লুকোনো টাকা, নীরব মোদি জালিয়াতি, ক্রিকেটে গড়াপেটা, ললিত মোদির ক্রিকেট কেলেঙ্কারি, বিজয় মাল্য আর্থিক কেলেঙ্কারি, বিষমদ কাণ্ড, আসল বোতলে নকল ব্ল্যাক লেবেল-শিভাস রিগাল, বেআইনি লেনদেন, এবিজি শিপইয়ার্ড ব্যাঙ্ক জালিয়াতি, রাজীব গান্ধী ফাউন্ডেশন-রাজীব গান্ধী চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট কেলেঙ্কারি, ন্যাশানাল হেরাল্ড কেলেঙ্কারি , আলি বুদেশ, আনিশ ইব্রাহিম, দাউদ ইব্রাহিম, হাসান আলি খান, আবদুল লতিফ, হাজি মস্তান, টাইগার মেমন, ইয়াকুব মেমন, ভরদারাজন মুদালিয়ার, ছোটা রাজন, ছোটা শাকিল, বক্সার ভাদিভেলু, বীরপ্পন, হেরোইন, আফিম, কোকেন, গুণ্ডা, মস্তান, অমিত ভরদ্বাজ, মেহুল চোকশি, সয়েফ দরবার, রাজকিশোর দত্ত, রজত গুপ্ত, হরশদ মেহতা, নটওয়রলাল, শিবাজী পাঁজা, রামালিঙ্গা রাজু, জি জনার্দন রেড্ডি, আবদুল করিম তেলগি, মুখতার আনসারি, ঠগ বেহরাম, লরেন্স বিশনোই, দিলীপ বুয়া, রঞ্জিত চিমা, মায়া ডোলাস, কোলি ফয়াজ, ভিকি গোস্বামী, সান্তোখবেন জাদেজা, এম পি জয়রাজ, বিনদি জোহাল, এজাজ লাকড়াওয়ালা, করিম লালা, ভুরা মুঞ্জা, নায়িম, রবি পুজারী, মুথাপ্পা রায়, ছোটা রাজন, গোপাল রাজওয়ানি, কোতওয়াল রামচন্দ্র, আবু সালেম, অগ্নি শ্রীধর, শ্রীপ্রকাশ শুক্লা, মানয়া সুরভে, হরিশংকর তিওয়ারি, আক্কু যাদব, ডি পি যাদব, মায়া ডোলাস, আনন্দপাল সিং, নির্ভয় গুজ্জরম মণীন্দ্রপাল সিং, জালিয়াৎ, অপহরণকারী, চন্দ্রমোহন শর্মা, ধন্না সিং,এম জয়শংকর, রিপার জয়নন্দন, চন্দ্রকান্ত ঝা, মোহন কুমার, রভিন্দর কুমার, মোট্টা নাভাস, সন্তোষ পোল, রমণ রাঘব, উমেশ রেড্ডি, সতীশ, দেবেন্দ্র শর্মা, দরবারা সিং,আশারাম, ফলাহারিবাবা, এম জয়শংকর, মনিন্দরপাল সিং কোহলি, বিট্টি মোহান্তি, সুনীল রস্তোগি, উমেশ রেড্ডি, সতীশ, দরবরা সিং, তাঁতিয়া ভীল, ফুলন দেবী, কোলি ফয়াজ, ইথিক্কারা পাক্কি, জম্বুলিঙ্গম নাদার, জগ্গা জাট, সীমা পরিহার, শিবকুমার প্যাটেল, কোতওয়াল রামচন্দ্র, দেবেন্দ্র শর্মা, মান সিং, পানসিং তোমার, কিরণজিত সিং আহলুওয়ালিয়া, নভজ্যোত সিং সিধু, হংসরাজ গঙ্গারাম আহির, প্রেমচন্দ গুপ্তা, এস জগতরকশাকন, শ্রীপ্রকাশ জায়সওয়াল, নবীন জিন্দল, মধু কোডা, দাসারি নারায়াণা রাও, সুবোধকান্ত সহায়, রাডিয়া টেপ, অজয় সিং চৌতালা, পুরুষোত্তম নরেশ দ্বিবেদী, পাপ্পু কালানি, রামনিবাস গোয়েল, বালমুকুন্দ গৌতম, মায়া কোডনানি, সজ্জনকুমার, বীর সিং মাহতো, বিক্রম সিং মাজিথিয়া, রশিদ মাসুদ, জগন্নাথ মিশ্রা, ভুরা মুঞ্জা, নীললোহিতাদাসন নাদার, ফ্রানসিসকো পাচেকো, রাজু পাল, আর বালকৃষ্ণ পিল্লাই, মনোজ প্রধান, প্রবোধ পুরকাইত, গোপাল রাজওয়ানি, সাহি রাম, সুখ রাম, সুরেশ রাণা, ভি কে শশীকলা, টি এম সেলভাগণপতি, মোহম্মদ শাহাবুদ্দিন, জগদীশ শর্মা, রাধারমণ শাস্ত্রী, বিজয়কুমার শুক্লা, তাহির হুসেন সিদ্দিক, অক্ষয়প্রতাপ সিং, আনন্দমোহন সিং, অনন্তকুমার সিং, প্রভূনাথ সিং, সঞ্জীব সিং, সুরজভান সিং, মোহম্মদ সুর্তি, প্রেম খাণ্ডু থুঙ্গন, শেখর তিওয়ারি, সান্দ্রা ভেঙ্কটা ভিরাইয়া, আনন্দসেন যাদব, মহেন্দ্র যাদব, বন্যপ্রাণীর দেহাংশ বিক্রি, জুলুমবাজি, দাঙ্গা, সন্ত্রাস, সুপারি কিলিঙ, শিশু চুরি, অবৈধ গর্ভপাত, ছিনতাই, এনকাউন্টার, মিত্রোখিন পেপার্স, হিংসা, হপ্তাউসুলি, ডাকাতি, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, প্রোটেকশান মানি এটসেটরা ।

বন্ধুনি : বাপ্রে ! দেশটা এতো গণ্ডোগোল সামলায় কেমন করে ! এ তো রসাতল ! রসাতল ! দুর্নীতি শব্দটা যখন বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার হয় তখন সাংস্কৃতিক অর্থে “সমূলে বিনষ্ট হওয়াকে” নির্দেশ করে। আমরা সত্যিই এগিয়ে চলেছি সেই পথে ।

আমি : স্বাধীন ভারতে ঘুষ খাবার আদি পর্বটা কিন্তু কৃষ্ণ মেনন শুরু করেছিল, নেহেরুর পেয়ারের লোক । ১৯৪৭-৪৮ সালে, দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে, পাকিস্তান দখল করতে চাইছে কাশ্মীর, তার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ভারতের আরও কিছু জিপ গাড়ির দরকার ছিল। তখন ব্রিটেনের ভারতীয় হাইকমিশনার ভি. কে. কৃষ্ণ মেনন পুরোনো মেরামত করা ২০০০ জিপ কেনার জন্য  অর্ডার দেন ৷ ওই পুরনো  জীপ কিনতে যে দাম দেওয়া হচ্ছিল সেই  দামেই নতুন জীপ কেনা যেত আমেরিকা বা কানাডা থেকে । নাম না-জানা  যে অ্যান্টি-মিস্টান্টেসকে জিপগুলো সরবরাহ করার জন্য বরাত দেওয়া হয়েছিল, তার মূলধন ছিল মাত্র ৬০৫ পাউন্ড। কৃষ্ণমেনন এজন্য ১৭২০০০ ডলার দিতে রাজি হন ।তার মধ্যে মোট পেমেন্টের ৬৫% কোনো পরিদর্শন শংসাপত্র ছাড়াই দেওয়া হয় আর ডেলিভারি দেওয়ার সময় ২০% । বাদবাকি টাকা ডেলিভারী হওয়ার এক মাস পরে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়৷ কোম্পানিটি অবশ্য দুই বছরে মাত্র ৫৯টি জিপ সরবরাহ করে  সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার করে।ব্রিটেন কর্তৃক জিপগুলির অর্থ প্রদান ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ভারতকে ব্রিটিশ যুদ্ধ ঋণের অংশ হিসেবে ।  মেনন এই চুক্তিতে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন। মেনন প্রোটোকল এড়িয়ে একটি ৮০ লক্ষ টাকার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন । যদিও বেশিরভাগ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল , মাত্র ১৫৫টা জিপ ডেলিভারি করা হয়েছিল ; যদিও প্রটোকল অনুসারে মেননকে পদত্যাগ করে ভারতে ফিরে আসতে বলা হয়, তবে নেহেরু সরকারকে জিপগুলি গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলেন । এদিকে চুক্তির তথ্য ভারতে পৌঁছলে এখানকার সংসদ সহ গোটা দেশে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয় ।

বন্ধুনি : আপনি মিত্রোখিন পেপার্সের খবর পড়েছেন ? ইনডিয়াকে আমাদের চেয়ে বিদেশিরা বেশি বুঝেছে। সোভিয়েত আমলের গুপ্তচর মিত্রোখিন যেসব কাগজপত্র রেখে গেছে তাতে দাবি করেছে যে কৃষ্ণমেননের ১৯৬২ আর ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে ওরা প্রচুর টাকা দিয়েছিল ওনাকে জেতাবার জনয় । কৃষ্ণমেনন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হয়ে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমানের বদলে তাই সোভিয়েত মিগ কিনেছিলেন

আমি : জানি, জানিমেনন দুজন মেমের প্রেমে পড়িছিলেন । ওনার জিপ কেনার কেলেঙ্কারি তদন্ত করেছিল আয়ঙ্গার সাব-কমিটি আর ১৯৫১ সালের ৯ই এপ্রিল নেহরুর কাছে পেশ করা রিপোর্টে গোলমালের তথ্যগুলো ছিল। তদন্ত হয়েছিল ; সেসব ধামাচাপা পড়ে যায়  পরে, মেননকে কোনও পোর্টফোলিও ছাড়াই অবশ্য মন্ত্রী হিসেবে নেহরু মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে মেনন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিশ্বস্ত বন্ধু হন। মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব , ইউ ভি কল্যাণম , এক সংবাদপত্রের সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, এটা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে নেহরু, কৃষ্ণমেননের মতো দুর্নীতিবাজ সহকর্মী তৈরি করেছিলেন, যিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থাকাকালীন কুখ্যাত ‘ জীপ কেলেঙ্কারি ‘তে জড়িয়ে পড়েন৷ 

বন্ধুনি : মিত্রোখিন লিখেছে  যে জোসেফ স্টালিন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সম্পর্কে ভালো মতামত দেননি । স্ট্যালিন মনে করতেন  নেহেরু আর মহাত্মা গান্ধী দুজনে “সাম্রাজ্যবাদী পুতুল” , যারা ব্রিটিশদের সামনে মাথা নত করেছিল আর তাদের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, ব্রিটিশদের ভারতে তাদের দখল শক্ত করতে সাহায্য করেছিল। মিত্রোখিন আরও লিখেছে যে ইন্দিরা গান্ধীকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের বিনিময়ে দুকোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল আর সোভিয়েত গুপ্তচরদের অবাক করে দিয়ে, তিনি যে ব্যাগটিতে টাকা পেয়েছিলেন তাও ফেরত দেননি।

আমি : তার আগের ব্যাপারটা জানিস ? ১৬ ই আগস্ট ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় মুসলিম লিগের সভা। বিভিন্ন ধরনের প্রাণঘাতী অস্ত্র হাতে সেদিন সভায় উপস্থিত ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার মুসলমান। মঞ্চে উপস্থিত ছিল হোসেন সোহরাওয়ার্দী‚ খাজা নাজিমুদ্দিন‚ ইস্পাহানি ও মুসলিম লিগপন্থী দলিত নেতা যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। সমর্থকদের উদ্দেশ্যে সোহরাওয়ার্দী সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়‚ “সেনা ও পুলিশকে সংযত করা হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম‚যা করতে পারিস কর। সভা শেষ হতেই উপস্থিত মুসলমান জনতা প্রথমে আক্রমণ করে সভা দেখতে আসা হিন্দু জনতাদের। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ – হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে তারা দল বেঁধে ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বিভিন্ন রাস্তা ধরে। অবাধে চলে লুটপাট‚ খুন জখম‚ ধর্ষণ। ক্যানিং স্ট্রিট‚ ওয়েলেসলি স্ট্রিট‚ ধর্মতলা স্ট্রিট‚ কর্পোরেশন স্ট্রিট‚ মানিকতলা রোড আর বিবেকানন্দ রোডে গণলুঠ হয়। লুট হয় কমলালয় স্টোর্স‚ ভারতকলা ভান্ডার‚ লক্ষ্মী স্টোর্সের মতো বিখ্যাত দোকানগুলো। আক্রান্ত হয় উত্তর ও মধ্য কলকাতার হিন্দু পাড়াগুলি। গড়পাড়‚ নারকেলডাঙা‚ বেলেঘাটা‚ ফুলবাগান‚ পার্ক সার্কাস‚ কলুটোলা‚ চিৎপুর জুড়ে সন্ত্রাস চালিয়ে বেড়ায় ‘মুসলিম লিডার’-রা। আর শুধু সাধারণ মানুষই না‚ তাদের আক্রমণ থেকে বাদ পড়েননি অভিনেতা ছবি বিশ্বাস‚ গণিতজ্ঞ যাদব চক্রবর্তী‚ রাজা দেবেন্দ্র মল্লিক‚ ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এস.এস.মুখার্জির মতো বিশিষ্ট বাঙ্গালিরাও। আক্ষরিক অর্থেই যেন একখণ্ড নরক নেমে আসে কলকাতার বুকে। নিহত হয় অসংখ্য হিন্দু‚ ধর্ষিতাদের সংখ্যা ছিলো অগুনতি। হিন্দুদের উপর বিজয়ের চিহ্ন স্বরূপ রাস্তার পাশে ধর্ষিতা মৃত মেয়েদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়। আক্রমণ চলল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও। ভিক্টোরিয়া কলেজের লেডিজ হোস্টেল আক্রমণ করে লিগের গুন্ডারা। অন্যান্য মেয়েরা সময়মতো বাড়িতে পালিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত পালাতে পারেনি চারজন ছাত্রী। হোস্টেলেই ছিল তারা।  হতভাগিনীদের উপর গণধর্ষণ চালিয়ে তাদের হত্যা করে আক্রমণকারীরা। ধর্ষণের পর তাদের স্তন কেটে নিয়ে তারপরে তাদের যৌনাঙ্গে গো-মাংস ঝোলানোর শিক ঢুকিয়ে‚ তাদের মৃতদেহগুলিকে কলেজের দোতলার একটি ক্লাসরুম থেকে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল হিন্দুদের মধ্যে ভয় সৃষ্টির জন্য। আর শুধু বাঙ্গালিই নয়‚ হিন্দু হলেই আর ছাড় ছিল না কারও। মেটিয়াবুরুজে উড়িয়া শ্রমিকদের বস্তিতে চলে আক্রমণ। কম করে ৫০০ জন উড়িয়া শ্রমিককে সেখানে হত্যা করা হয়েছিলো। অসহায় শ্রমিকদের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিলো সেদিন হুগলি নদীর জল।

বন্ধুনি : ঠিক বলেছেন । সেই থেকে কলকাতা হয়ে গেছে হত্যার শহর ।

আমি : দেশভাগ ! ওফ ভাবা যায় না । 

বন্ধুনি : আপনি পড়েননি  বোধহয়, ‘ফ্রম প্ল্যাসি টু পাকিস্তান’-বইতে হুমায়ূন মির্জা লিখছেন, “পাকিস্তানের এক সময়কার প্রতিরক্ষা সচিব ইসকান্দার মির্জা, যিনি পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন, তিনি মি. জিন্নাহকে বলেছিলেন, যে মুসিলম লীগ পাকিস্তান দিল, সেই দলটাকে যেন অবহেলা করা না হয়।”  সঙ্গে সঙ্গে মি. জিন্নাহ পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন, “কে বলল মুসলিম লীগ আমাদের পাকিস্তান দিয়েছে? আমি পাকিস্তান বানিয়েছি, আমার স্টেনোগ্রাফারের সাহায্যে।”

আমি : আরে কী যে বলিস, সেই কবে পড়েছি,  খালিদ লতিফ গৌবা এক জায়গায় লিখেছিলেন যে তিনি মি. জিন্নাহকে কোনও একটা মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। “আমি জানি না কীভাবে নামাজ পড়তে হয়,” জবাব দিয়েছিলেন মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ। মি. গৌবা বলেছিলেন, “মসজিদে অন্যরা যা করবে, আপনিও তাদের দেখাদেখি সেটাই না হয় করবেন।”

বন্ধুনি : আপনি এটা জানেন  ? মি. জিন্নাহর সহকারী ছিলেন মুহাম্মদ করিম চাগলা, যিনি পরে ভারতের বিদেশ মন্ত্রী হয়েছিলেন।তিনি আত্মজীবনী ‘রোজেস ইন ডিসেম্বর’-এ লিখেছেন, “একবার আমি আর মি. জিন্নাহ ঠিক করেছিলাম বোম্বের বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ‘কর্ণগ্লিয়াজ’-এ খেতে যাব। উনি দু কাপ কফি, পেস্ট্রি আর শুয়োরের মাংসের সসেজ অর্ডার করলেন। আমরা বেশ তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছিলাম। হঠাৎই এক বয়স্ক দাড়িওয়ালা মুসলমান ব্যক্তি ওখানে হাজির হলেন, তাঁর সঙ্গে একটা বছর দশেকের বাচ্চা ছেলে।” “ওঁরা মি. জিন্নাহর বেশ কাছাকাছি বসেছিলেন। হঠাৎ খেয়াল করলাম, ওই বাচ্চা ছেলেটি মি. জিন্নাহর সামনে রাখা সসেজের দিকে হাত বাড়াচ্ছে আর তারপরেই ছোট একটা টুকরো তুলে নিজের মুখে পুরে দিল। আমি এই বাচ্চাটার কাণ্ড দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলাম।” একটু পরে ওঁরা চলে গেলেন। তখন মি. জিন্নাহ আমার ওপরে বেশ রেগে গিয়ে বললেন, “চাগলা, তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। ওই বাচ্চা ছেলেটাকে শুয়োরের মাংসের সসেজ খেতে দিলে তুমি?”

আমি : বুঝলি, ইনডিয়াকে ডিফাইন করে কেলেঙ্কারিগুলো । তোমরা স্বীকার করো বা না করো । স্বাধীন ভারতের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি হয়েছিল ১৯৫৭  সালে । এখনকার কেলেঙ্কারিগুলোর তুলনায় মামুলি, কিন্তু সেসময়ে, সবে সংবিধান মেনে রাষ্ট্র চলতে আরম্ভ করেছে, কেলেঙ্কারিটা ছিল বোমা ফাটার মতন । অর্থমন্ত্রী, টি টি কৃষ্ণমাচারীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। জানা যায় যে, ১৯৫৭ সালের জুন মাসে পাবলিক সেক্টর লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশন (এলআইসি) কলকাতা-ভিত্তিক ব্যবসায়ী হরিদাস মুন্ধ্রার মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানিতে ১.২৪ কোটি  টাকা মূল্যের জালি স্টক কিনেছিল। . এলআইসির তখন পর্যন্ত ইতিহাসে বিনিয়োগটি সবচেয়ে বড় ছিল, কিন্তু নিয়মানুযায়ী তার বিনিয়োগ কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করা হয়নি। ব্যবসায়িক সাংবাদিক সুচেতা দালাল তার শিল্পপতি এ.ডি. শ্রফের জীবনীতে লিখেছেন, “প্রচুর প্রমাণ ছিল,” যে মিঃ মুন্ধরা “কোম্পানিগুলোকে রক্তাক্ত করছিলেন আর বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিলেন, একই সাথে বাজারে  ফাটকা খেলে দাম বাড়াচ্ছিলেন।”

বন্ধুনি : আপনিও জানেন কি না জানি না, নেহেরু যুগে, কংগ্রেস প্রায়ই শিল্পপতি আর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করত, যা কখনও কখনও দল আর সরকারকে সমস্যায় ফেলেছিল। যেমন, যখন মুন্ধরা, একজন শিল্পপতি যিনি ১৯৫০ এর দশকে পার্টিকে অর্থায়ন করেছিলেন, আর্থিক সমস্যায় পড়েছিলেন, তখন তিনি সরকারকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে এটি ফেরত দেওয়ার সময়। নেহেরু বাধ্য হয়ে এলআইসিকে তার কোম্পানির শেয়ার স্ফীত দামে কেনার নির্দেশ দেন। অর্থমন্ত্রী টি টি কৃষ্ণমাচারী, যিনি স্পষ্টতই উপর থেকে নির্দেশে কাজ করছিলেন, সত্য বেরিয়ে এলে চাকরি হারান।

আমি : সবচেয়ে আগে জওয়াহারলাল নেহেরুর প্রেমের কথা বল ! ওই মোটা লোকটা একজন যুবতীর প্রেমে পড়ে নানা গোলমাল করেছে বলে লোকেরা চেল্লাচ্ছে । নেহেরুর প্রেম নিয়ে সেসময়ে তেমন চেঁচামেচি হয়নি । ডিকি মাউন্টব্যাটেন লোকটাও কেমন ! বউয়ের সঙ্গে ওপন ম্যারেজ চুক্তি করে ফেললো যাতে দুজনে যার সঙ্গে ইচ্ছে প্রেম করতে পারে । কে কার সঙ্গে সেক্স করছে দ্যাট ইজ ইমম্যাটেরিয়াল । দেশ স্বাধীন হতে চলেছে, লক্ষ-লক্ষ মানুষ চোদ্দোপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য জায়গায় মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে, কতো বউরা-মেয়েরা ধর্ষিত হচ্ছে, খুনোখুনিতে মারা পড়ছে হাজার-হাজার মানুষ, আর তুমি তখন একজন মেমের সঙ্গে প্রেম করছ। একটা ফোটোতে দেখেছি, মাউন্টব্যাটেন ক্যাবলার মতন দাঁড়িয়ে রয়েছে আর ওর পেছনে হাসাহাসি করছে নেহেরু আর এডউইনা । নকল হাসি নয়, বুকভরা হাসির ছররা ।  জওহরলাল-এডউইনা-মাউন্টব্যাটেনের সম্পর্ক পাবলিকের সামনে আসার পর্বটাও  হয়েছিল  নোংরামি ও কদর্যতার মাধ্যমে, যখন আরেক বিবাহিতা নারী আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল তার স্বামীর সাথে এডুইনার অবৈধ প্রণয়ের ব্যাপারে নালিশ জানাতে। এছাড়া এডুইনা ভালোবাসার খেলায় মেতেছিল লেসলি হাচিনসন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পীর সাথেও, যে বিষয়টা পাবলিকের নজরে এলে চারিদিকে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল।  স্ত্রীর পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে খুব বেশি দুঃখবিলাস করেনি মাউন্টব্যাটেন। অনেকের মতে, স্ত্রী সম্পর্কে মাউন্টব্যাটেন হয়ে পড়েছিল উদাসীন । ১৯২৯ সাল নাগাদ, মাউন্টব্যাটেন এডুইনার সাথে এক  সন্ধিচুক্তি করেছিল, যাকে ওরা বলে ‘খোলা বিয়ে’ । 

বন্ধুনি : আপনি ওটা জানেন? ওরা যেদিন আমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, সেদিনের বিদায় সভায় নেহেরু সরাসরি এডউইনাকে সবায়ের সামনে বলেছিল, আপনি যেখানেই গেছেন, আপনি সান্ত্বনা এনেছেন, আপনি আশা এবং উৎসাহ এনেছেন ; এটা কতো আশ্চর্যের বিষয় যে ভারতের জনগণ আপনাকে ভালবাসবে এবং আপনাকে নিজেদের একজন হিসাবে দেখবে এবং আপনি যাচ্ছেন বলে দুঃখিত হবে । ওদের মধ্যে প্লেটোনিক সম্পর্ক ছিল নাকি যৌন সম্পর্ক ছিল তা কেউই জানে না। তার এডউইনার মেয়ে স্বীকার করেছে যে ১৯৪৭ সালের পরেও তারা ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ওরা চিঠি আদান প্রদান করত । ১৯৬০ সালে এডউইনা মারা যান। মেয়ে লিখেছেন যে তার মা নেহেরুর সাথে বেশ উন্মাদভাবে সম্পর্কিত ছিলেন, এতটাই যে মিস্টার মাউন্টব্যাটেনও চোখ বন্ধ করতেন যেমনটি আমরা অনেক ঐতিহাসিক ছবিতে দেখতে পাই ।

আমি : হ্যাঁ, ছবি দেখেছি ।

বন্ধুনি :নেহেরু সেই সময়ে একজন বিপত্নীক আর সমসাময়িক ভারতীয়দের তুলনায়  ‘আধুনিক’ ছিলেন, তাই এডউইনার সাথে একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে নিয়েছিলেন, যদিও হয়তো শারীরিক নয়, কিন্তু এমন কিছু যা খুব কমই স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের আজও করতে দেয়। এডউইনার ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়, যাঁকে সেই সময়ে সেরা পোশাক পরা মহিলাদের একজন হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল, যিনি জমকালোভাবে কেনাকাটা করতেন, পার্টিতে  চটকদার ছিলেন আর ওনার নৌ অফিসার ভাইসরয় স্বামী  তার চেয়ে অনেক বেশি গ্ল্যামারাস ছিলেন। স্বামী লোকটি তার স্ত্রীর সাথে খুব বেশি রোমান্টিকভাবে যুক্ত ছিলেন না । তাঁরও বহু যুবতীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। মাউন্টব্যাটেন একবার বলেছিলেন, তারা দম্পতি হলেও, দুজনেই বিছানায় অন্যদের সাথে বেশি সময় কাটিয়েছেন।

আমি :  তুই এটা বোধহয় শুনিসনি ।নেহরুর আগে বা হয়তো তাঁর সাথে থাকাকালীনও, সামাজিক প্রজাপতি এডউইনার অনেক অভিজাত ইংরেজ আর আমেরিকান পুরুষদের সাথে সম্পর্ক ছিল ,এমনকি যৌন সম্পর্ক, অভিজাত থেকে মিডিয়া হাউসের মালিকদের সঙ্গে আর তাও মেয়ের জন্মের পরে।  তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে নেহরুর পক্ষে তার সাথে ফ্লার্ট করা সহজ ছিল।

বন্ধুনি : আমি ইনডিয়াকে ডিফাইন করতে আরেকটা পয়েন্ট দিচ্ছি । যখন ইরফান খান, হিউ গ্রান্ট আর কেট ব্ল্যানচেটকে নিয়ে এই বিষয়ে একটা ফিল্ম তৈরি হচ্ছিল,  তখন এটার শুটিঙ ভারতের গোপন ধমকানিতে  নাটকীয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এর পরের কংগ্রেস সরকারগুলো এই ঘটনাটা লুকিয়ে রাখতে  হয়েছিল। শাসকদের ভয় ছিল গ্রামীণ ভোটব্যাংক। কিন্তু একই সময়ে তারা সম্পূর্ণভাবে বা সম্ভবত অসতর্কতার সাথে এটি অভিজাতদের কাছ থেকে আড়াল করতে ব্যর্থ হয়েছে, যাদের অবশ্য এতে কোন সমস্যা ছিল না । ওই লুকোছাপা থেকেই আরম্ভ হলো রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক দুরাচার ।

আমি : নেহেরুর ভূমিকায় ইরফান খান অসাধারণ অভিনয় করতো । কেন যে লোকটা এতো তাড়াতাড়ি মারা গেল !

বন্ধুনি : এডউইনার চেয়ে কেট ব্ল্যানচেট হাজারগুণ সুন্দরী । এলিজাবেথ ফিল্মটায় কতো ভালো দেখাচ্ছিল ওনাকে। উনি তো অস্ট্রেলিয়ান, ইংরেজদের মতন ইংরেজি বলতে হয়েছিল । যাই হোক না কেন, কিন্তু  নেহরু সেসময়ে  ‘বামপন্থী’ তরুণদের প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। রাশিয়ার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নকল করে । ওনার প্রেমের গল্প, যদিও স্বর্গীয় নয়, অবশ্যই আকর্ষণীয় আর আনন্দদায়ক ।

আমি : তোকে একটা কথা মানতেই হবে । যাঁরা প্রায়ই নেহরুর যুগকে ভারতীয় গণতন্ত্রের সোনালি সময় বলে দাবি করেন তাঁদের সম্ভবত বুঝতে হবে যে দুর্ভাগ্যবশত, নেহেরুর উত্তরাধিকার আরও বেশি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বকালীন সময়ে যে পচন তৈরি হয়েছিল তা আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে পরপর কংগ্রেস সরকারের রাজত্বে । নেহেরুর উন্নয়ন বা শাসনের মডেল যা কংগ্রেস কয়েক দশক ধরে কেন্দ্র আর রাজ্যের স্তরে গর্বের সাথে এগিয়ে নিয়ে গেছে তা আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার আর দায়িত্ব নির্ধারণ করা দরকার কারণ ভারতের নাগরিকদের দুর্নীতি, অদক্ষতার জন্য বিশাল মূল্য চোকাতে হচ্ছে ।  স্বজনপ্রীতি শাসনের নেহেরু মডেলের বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে ; যে সরকারই গদিতে বসুক তারা স্বজনপ্রীতির মডেলটা দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে গেছে। এটা বললে ভুল হবে না যে আমাদের শাসন ব্যবস্থার তিনটি প্রধান অসুখের শিকড় –- দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর অদক্ষতা, নেহেরু যুগে অঙ্কুরিত  হয়ে এখন মহীরুহ হয়ে গেছে ।

বন্ধুনি : স্বাধীনতার পরপরই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ভারতীয় কৃষিকে পুনরুজ্জীবিত করা আর লক্ষ লক্ষ ভারতীয়দের পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা, যাদের ক্ষুধার্ত থাকতে হচ্ছিল।“কৃষি আর লাখ লাখ মানুষের খাদ্য উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়ায় সামান্য অগ্রগতি দেখা গেছে পরে । ভারতে  খাদ্যের উৎপাদন,  প্রতি একর ফলন উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিন্তু বিপজ্জনকভাবে কয়েক বছর ধরে গোপন করা হয়েছিল।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে লক্ষ লক্ষ টন বিনামূল্যে বা ডাম্প করা খাবারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কিছু মন্ত্রীর বরং লাভ হচ্ছিল।  চল্লিশের দশকে বাংলার দুর্ভিক্ষ থেকে স্পষ্টতই, নেহরুর সময়ে   কোনও উপযুক্ত শস্যভাণ্ডার বা স্টোরেজ ব্যবস্থা ছিল না। এইভাবে দুর্ভিক্ষ,   শস্য ফটকাবাজ আর মজুতদারদের টাকার ভাঁড়ার উপচে তোলে ।

আমি : প্রকৃতপক্ষে, নেহরুর শহুরে মানসিকতা এবং গ্রামীণ ভারতের সাথে তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া একটি দক্ষ শাসন মডেল স্থাপনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শহুরে মন প্রতিফলিত হয়। নেহরু, বেশিরভাগ ভারতীয় রাজনীতিবিদদের মতো, শহুরে ছিলেন। তাদের শহরের বাইরে রাজনীতিবিদরা পানি ছাড়া মাছের মতো। এই কারণেই কৃষিকে, যদিও হাজার হাজার পৃষ্ঠা, লক্ষ লক্ষ শব্দ, এবং বিভিন্ন বিশাল প্রকল্প, যেমন সম্প্রদায়ের উন্নয়ন বা গ্রো মোর ফুড ক্যাম্পেইন দেওয়া হয়েছে, পর্যাপ্ত কার্যকর পদক্ষেপ দেওয়া হয়নি… যেমন নেহরু পরিকল্পনা বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়েছে, এবং তা ছাড়া সাধারণ কৌশল, তারা ছোট কারিগরি স্কুল থেকে শুরু করে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পর্যন্ত শত শত বিভিন্ন প্রকল্পে চলে কিন্তু তারা তাদের অগ্রাধিকার বা লক্ষ্যে খুব বেশি অশুদ্ধ হওয়ার প্রবণতা দেখায়; বুদ্ধিবৃত্তিক এবং তারপরে কঠিন প্রযুক্তিগত প্রস্তুতির ভিত্তির খুব অভাব… সম্পাদনে খুব বেশি ত্রুটি যাতে অনেক, সম্ভবত, বেশিরভাগ লক্ষ্য এবং ভার্চুয়াল ব্যর্থতার ক্ষেত্রে একটি ঘাটতি হয়েছে।

বন্ধুনি : নেহেরু মদ-মাংস খেতেন ?

আমি : নেহেরু  ওয়াইন আর শ্যাম্পেন পছন্দ করতেন, বি.কে.নেহেরুর স্মৃতিচারণ অনুযায়ী । কমিউনিস্ট দেশগুলোর জন্য নিয়ম ভাঙতে ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে  তিনি অনড় ছিলেন। নেহেরু যখন রাষ্ট্রপতি কেনেডির সাথে দেখা করতে যান, তখন বি কে নেহরুকে দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছিল, কোনও হুইস্কি বা জিন নয়; শুধুমাত্র ওয়াইন আর শ্যাম্পেন।  নেহেরু খুব অসুস্থ এবং ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তাই তিনি নিজেও শ্যাম্পেন ককটেল গিলেছিলেন । বি.কে.নেহেরু লিখেছেন যে নেহেরু সেরিন একটি বড় গ্লাস চোঁচোঁ করে খেয়ে বললেন, এর স্বাদ খুব ভাল, আরও  এক গ্লাস দাও ।

বন্ধুনি : আমি একটা পয়েন্ট দিচ্ছি ।দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে, গান্ধীজির প্রাক্তন ব্যক্তিগত সচিব ভি কল্যাণম, গান্ধী জয়ন্তীর প্রাক্কালে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে আজ দেশে দুর্নীতির ক্রমবর্ধমান মাত্রার জন্য দায়ী করেছেন। এই গান্ধীবাদী, যিনি ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত মহাত্মা গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে কাজ করেছিলেন, দাবি করেছেন, পন্ডিত নেহেরু ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সৎ ছিলেন। মনমোহন সিংয়ের মতোই সৎ। বর্তমান দুর্নীতির জন্য আমি মনমোহন সিংকেও দায়ী করি। মনমোহন সিং ব্যক্তিগতভাবে খুবই সৎ। কিন্তু তাঁরা দুর্নীতিবাজদের  রক্ষা করেছেন। তাই আমি বলি তারা সবাই দুর্নীতিকে মদদ দিয়েছে। কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত হলে, আপনার উচিত তাদের শাস্তি দেওয়া । কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে, তাকে, আপনার উচিত অবিলম্বে বরখাস্ত করা ।  ভারতের স্বাধীনতার এক মাসের মধ্যে, গান্ধীজি পঞ্চাশটি চিঠি পেয়েছিলেন, যার মধ্যে দশটিতে  দেশে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। কল্যাণম অভিযোগ করেছেন, তখন তিনজন ব্যক্তি খুব দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণ মেনন, পন্ডিত নেহরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী টিটি কৃষ্ণমাচারী আর পাঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রতাপ সিং কাইরন । কিন্তু নেহেরু তাদের বরখাস্ত করেননি।  আমি এখন ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির জন্য নেহেরুকে দায়ী করি।”

আমি : বুঝলি, আলটিমেটলি,বিউটি অ্যান্ড দি বিস্টের ব্যাপার । কিংবা ব্যাঙ আর রাজকুমারী । ওই দুজনের আর নেহেরু ও কৃষ্ণমেননের প্রেমকে অনুমোদন করে বলল, তোমরা নাস্তিক বলে হিন্দু দেবী-দেবতার খবর রাখো না । জানো, পুরাণের সূর্য আর চন্দ্রের গল্প ?  চন্দ্র দক্ষের সাতাশটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু  কামাসক্ত হয়ে সে দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারাকে অপহরণ করে সঙ্গম করেছিল । দেবগুরু বৃহস্পতি প্রেমে অভিভূত হয়ে নিজের বড়ো ভাইয়ের স্ত্রী মমতা অন্তস্বত্বা থাকা সত্বেও তার সঙ্গে সঙ্গম করেছিল। আবার ঋগ্বেদে আছে রুদ্রদেব তার নিজের মেয়ে উষার সঙ্গে অজাচারে লিপ্ত হয়েছিল। পৌরাণিক যুগে বিষ্ণুই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। কিন্তু তিনিও পরস্ত্রী বৃন্দা ও তুলসীর সতীত্ব নাশ করেছিলেন।

বন্ধুনি :  আচ্ছা, এই সতীত্ব নিয়ে এরকম দুশ্চিন্তা ইউরোপ-আমেরিকায় তো নেই ? ইনডিয়াকে নয়, এই ব্যাপারটা ভারতবর্ষকে ডিফাইন করে ।

আমি : আরে বলিসনি ! মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে  যখন মেয়েদের নৈতিকতা সম্পর্কে শেখানো হয়, তখন প্রায়ই সহানুভূতি, দয়া, সাহস বা সততার কথা বলা হয় না। বলা হয় সতীচ্ছদ বা যোনিচ্ছদ নিয়ে । আমি কাজের সূত্রে আরব দেশগুলোতে গেছি । সতীচ্ছদের দেবতা আরব দেশগুলোতে জনপ্রিয়। তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো বা গোপন নাস্তিক হও, কোন ধর্মের তা বিবেচ্য নয়,  পুরুষরা প্রত্যেকেই সতীচ্ছদের দেবতার পূজা করে। সতীচ্ছদ, যা সবচেয়ে অপলকা অংশ, যার ওপর কুমারীত্বের দেবতা বসে আছেন, তাকে  অক্ষত রাখার জন্য যা কিছু সম্ভব করে ওদের দেশের কর্তাবাবারা৷ সতীচ্ছদের দেবতার বেদিতে,  কেবল  মেয়েদের শারীরিক পরিপূর্ণতা আর  আনন্দের অধিকারই নয়, যৌন নিষেধের মুখে তাদের ন্যায়বিচারের অধিকারকেও বলি দেয়া হয় । কখনও কখনও  তাদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়, সম্মানের নামে । অনেক পরিবার তো  তাদের মেয়েদের মেরেও ফ্যালে, জাস্ট সতীচ্ছদের দেবতাকে সন্তুষ্ট রাখবার জন্য। পুরো সমাজ মনে হয় একটা পাতলা সতীচ্ছদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে ।

বন্ধুনি : কোনো-কোনো বাঙালি ফ্যামিলিরও অমন ছুয়াছুত আছে । হরিয়ানা সাইডে গ্রামে তো সুহাগ রাতের পর বাড়ির বাইরে চাদর টাঙিয়ে রক্তের ছোপ দেখানো হয় পাবলিককে ।

আমি : যাকগে,  তুই গড আর গডেসদের গল্পটা কনটিনিউ কর ।

বন্ধুনি : তার চেয়ে অপ্সরাদের গল্প শোনো । অপ্সরা বলে তো আর কিছু হতে পারে না, তাই গল্পগুলো বেশ ইনটারেস্টিঙ।

আমি : আরে, কী যে বলিস ! অপ্সরা হতে পারে না তো তোমাদের পলিটিশিয়ানগুলো কাদের প্রেমে হাবুডুবে খেয়েছে আর এখনও খাচ্ছে ? টিভি আর ফিল্মের নায়িকাদের দেখেছো ? অপ্সরাদের চেয়ে সুন্দরী ।

বন্ধুনি : শোনো না, বলছি তো অপ্সরাদের কাহিনি । চোখ বুজে কোনো ফিল্মের নায়িকাকে মনে করে নাও। পুরুরবা আর উর্বশীর মিলনের সবচেয়ে পুরোনো উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের সংবাদসুক্তে। সেখানে যে আখ্যান আছে, সে আখ্যান অনুযায়ী উর্বশী চার বছর পুরুরবার সঙ্গে ছিলেন, আর গর্ভবতী হবার পর উনি গায়েব হয়ে যান। শতপথব্ৰাহ্মণের কাহিনী অনুযায়ী উর্বশী কয়েকটা শর্তে পুরুরবার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকতে রাজী হন । প্রথম, উর্বশী যেন কোনদিন পুরুরবাকে উলঙ্গ না দেখেন, দ্বিতীয়, উর্বশীর বিছানার পাশে ছেলের মতন দুটো ভেড়া বাঁধা থাকবে আর কেউ যেম ভেড়াগুলোকে চুরি না করে। তৃতীয়,  উর্বশী একসন্ধ্যা শুধু ঘি খাবেন । অন্য কাহিনী অনুযায়ী আরও একটা শর্ত ছিল । সেটা হচ্ছে, উৰ্বশী কামাতুরা না হলে, সঙ্গম করা চলবে না। শতপথব্রাহ্মণ অনুযায়ী পুরুরবা শর্তগুলো মেনে নিতে রাজি হন।  পুরুরবা আর উর্বশী পরম সুখে অনেক বছর একসঙ্গে বসবাস করেন । কিন্তু দেবলোকে উর্বশীর অনুপস্থিতে গন্ধৰ্বরা ব্যথিত হয়ে ওঠে । গন্ধর্বরা তখন উৰ্বশীকে দেবলোকে নিয়ে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে । পুরুরবার সঙ্গে উর্বশীর বসবাসের শর্তগুলো তারা জানত। তাই ছলচাতুরি  করে তার শর্তগুলো ভাঙাবার উপায় বের করে। একদিন রাতে গন্ধৰ্ব বিশ্বাবসু, উর্বশীর ভেড়া দুটোকে চুরি করে । ভেড়াদের দেখতে না পেয়ে উর্বশী কাঁদতে-কাঁদতে পুরুরবাকে ভেড়া দুটোকে উদ্ধার করবার জন্য অনুরোধ করে । পুরুরবা উলঙ্গ অবস্থাতেই বিছানা থেকে  উঠে  বিশ্বাবসুকে ধরার জন্য দৌড়োয়।  এই সময় দেবতারা বজপাতের সূচনা করে বিদ্যুতের সৃষ্টি করে। বিদ্যুতের আলোকে উর্বশী পুরুরবাকে নগ্ন দেখে তৎক্ষণাৎ তাকে ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে যায়।

আমি : মুনি-ঋষিরা ল্যাংটো হয়ে শুতো ? ইনডিয়ায় তো কেউ অমন শোয় বলে মনে হয় না । আমেরিকায় শোয়, ইংল্যাণ্ডে জেমস বণ্ড শোয় ।

বন্ধুনি :আরে, পুরোটা শোনো না । পুরুরবা তখন উর্বশীর খোঁজে সারা দেশ ঘুরে বেড়ায়। একদিন কুরুক্ষেত্রের কাছে একটা পুকুরে পুরুরবা চারজন অপ্সরার সঙ্গে উর্বশীকে স্নান করতে দেখে । পুরুরবা তাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করে। উর্বশী বলে, ’আমি তোমার সহবাসে গর্ভবতী হয়েছি। তুমি এক বছর পর আমার সঙ্গে দেখা করলে, আমি তোমাকে আমার প্রথম সন্তান উপহার দেব এবং মাত্র একরাত্রি তোমার সঙ্গে বাস করব । এভাবে দীর্ঘ ছয় বছর কাল এক রাতের জন্য উর্বশী আর পুরুরবার মিলন ঘটতে থাকে। উর্বশীর চিরসঙ্গী ও চিরপ্রেমিক উর্বশীর গর্ভে মোট ছয় সন্তান হয়,  আয়ু, বিশ্বায়ু, অমাবসু, বলায়ু দৃঢ়ায়ু ও শতায়ু ।

আমি : তবে ? ভেবে দ্যাখ ! সামনের মারোয়াড়ি ফ্যামিলিতে একটা বউয়ের ছেলে হলো না বলে দুই ভাই মারামারি করে আলাদা হয়ে গেল !

বন্ধুনি : নেহেরুর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীও কম যান না । ওনার সম্পর্কেও অনেকে নানা কথা লিখে গেছে ওনার কাছের লোকেরা ।

আমি : হ্যাঁ, এমারজেন্সি, অপারেশান ব্লু স্টার, ঝুপড়ির মুসলমানদের খোজা বানানো, জিপগাড়ি স্ক্যাণ্ডাল । পরে, ১৯৬৯ সালে কংগ্রেস ভাঙার পর, ইন্দিরা গান্ধী টাকার জন্য কমিউনিস্ট দেশগুলোর ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবেই, সোভিয়েতরা তাঁকে উদ্ধার করেছিল। একটু আগে কথা উঠেছিল ভাসিলি মিত্রোখিনের, যিনি কেজিবি আর্কাইভসের দায়িত্বে ছিলেন, ১৯৭১ সালের নির্বাচনের আগে মস্কো কীভাবে কংগ্রেসের কার্যক্রমে টাকা যুগিয়েছিল সে সম্পর্কে বিস্ফোরক তথ্য প্রকাশ করেছেন। এমনকি ইন্দিরা গান্ধির ক্যাবিনেটেও সোভিয়েটের চর ছিল। ইতিহাস পড়েছিস ? মুঘল আমলে ছিল নজরানা, সেটাই স্বাধীনতার পর উৎকোচ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নজরানার অ্যামাউন্ট দুর্নীতিবাজ কাজীদের  আদালতে মামলার ভাগ্য নির্ধারণ করতো । নজরানা দিতে না পারলে চাষীদের না খেয়ে মরতে হতো । অনেক সময়ে  একজন দরবারী বা মনসবদারের চতুর্থবার বিয়ে করা নির্ভর করতো নজরানার ওপর। জাহাঙ্গিরের আমলে নজরানার নোংরামি নিয়ে লিখে গেছেন নেদারল্যাণ্ডসের পর্যটকরা। ওই ব্যাপারটাই নেহেরুর বংশের লোকেরা চালিয়ে গেছে ।

বন্ধুনি : আপনি কী জানেন, বি জি দেশমুখ, যিনি ১৯৮৬-৮৯ সালে মন্ত্রিপরিষদের সচিব ছিলেন, তিনি  আত্মজীবনীতে লিখেছেন: বোফর্স ঘটনার সূত্রপাত ইন্দিরা গান্ধীর শুরু করা প্যাঁচের  মধ্যে পড়ে । কংগ্রেস পার্টির জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য ওনার ছেলে সঞ্জয় তাকে আরও চেকনাই দিয়েছিল৷  ইন্দিরা, তিনি বলেছেন নির্বাচনের  জন্য আর দলের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য টাকা তোলা জরুরি মনে করেছিলেন। এর জন্য, তিনি রজনী প্যাটেল আর বসন্তরাও নায়েকের মতো অনুগত সমর্থকদের উপর নির্ভর করতেন। যখন ইন্দিরা ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে টাকা যোগাড়ের আরও ভাল উপায় হল বিদেশী লেনদেন থেকে কাটমানি নেয়া। সঞ্জয় গান্ধী ১৯৭২ সাল থেকে একে আরও নিখুঁত ও পরিমার্জিত করে ফেলেছিল ।

আমি : জানি, জানি, তুইই তো বইটা দিয়েছিলিস ।সেই যুগের আরও দু’জন সমানভাবে অপ্রতিরোধ্য সাক্ষী হলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি  ভেঙ্কটারমন এবং শিল্পপতি জে আর ডি টাটা। তার আত্মজীবনী মাই প্রেসিডেন্সিয়াল ইয়ার্স বইতে, ভেঙ্কটারমন টাটার সঙ্গে তাঁর  কথোপকথন বর্ণনা করেছেন। টাটা  বোফর্সের কাছ থেকে কংগ্রেস পার্টির কমিশনের প্রাপ্তি অস্বীকার করা কঠিন । কারণ টাটা অনুভব করেছিলেন যে ১৯৮০ সাল থেকে, শিল্পপতিদের টাকা দেবার জন্য যোগাযোগ করা হতো না । শিল্পপতিরা বুঝতে পেরেছিলেন  যে শাসক দল  কমিশন তুলছিলেন অস্ত্রচুক্তিগুলো থেকে । ব্যাপারটা তহবিল সংগ্রহের প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি হয়ে গিয়েছিল, তাই বোফর্স যে ঘটবে তা জানা কথা। এই কেলেঙ্কারিতে, রাজীব আর অন্যদের বিরুদ্ধে কমিশন নেবার অভিযোগ ছিল, সুইডিশ অস্ত্র প্রস্তুতকারক বোফর্সের কাছ থেকে । ভারত যখন সেনাবাহিনীর জন্য ফিল্ডগান কিনেছিল তখন কিকব্যাক নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। রাজীব সংসদে এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। যাইহোক, নেহেরু-গান্ধীরা কখনই ব্যাখ্যা করতে পারেননি যে  বোফর্স কোম্পানি কেন মারিয়া এবং ওটাভিও কোয়াত্রোচির অ্যাকাউন্টে  ৭.৩  মিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিল। 

বন্ধুনি : এই লোকটা স্ট্রেঞ্জ ! কোয়াত্রোচিরা এই টাকা বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ব্যাঙ্কে সরিয়ে রাখা আরম্ভ করেছিল।  শেষে  চ্যানেল দ্বীপপুঞ্জে নিয়ে গিয়ে রেখেছিল । বাজপেয়ী সরকার যুক্তরাজ্য সরকারকে এই অ্যাকাউন্টটি সিজ করতে বলেছিল, কিন্তু মনমোহন সিং সরকার লন্ডনকে তা প্রত্যাহার করতে আদেশ দেয়, যার ফলে কোয়াত্রোচিরা শেষ পর্যন্ত ৭.৩ মিলিয়ন ডলার নিয়ে পালিয়ে যায়। ভারত যখন তার সেনাবাহিনীর জন্য ফিল্ডগান কিনছিল তখন কেন একজন ইতালীয় ব্যবসায়ী কমিশন খেয়েছিল ? কেন সোনিয়া গান্ধী মনমোহন সিং সরকারকে কোয়াত্রোচিদের অ্যাকাউন্ট ডিফ্রিজ করতে আদেশ দিয়েছিলেন? 

আমি : ওই সময়ের আরেকটা ঘটনা হলো জাতিসংঘের খাদ্য’র জন্য তেল কর্মসূচির অধীনে ইরাকি তেল বিক্রির অ-চুক্তিমূলক সুবিধাভোগীদের বিষয়ে ভলকার কমিটির রিপোর্টে । তাতে বলা হয়েছে  যে ইরাকি স্বৈরশাসক সাদ্দাম হোসেন কংগ্রেসকে বেশ মোটা টাকা দিয়েছিলেন । মনে রাখা দরকার যে সাদ্দাম হোসেনের ইরাক ছিল জরুরী অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীর একনায়কত্বকে সমর্থনকারী দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি । 

বন্ধুনি : ভালো বলেছো ।ওনার কাটমানির গল্প ছাড়াও প্রেমের নানা কাহিনি শুনেছি আর পড়েছি । তরুণী আর যুবতী থাকাকালে, এমনকি বিয়ের পরেও একাধিক প্রেমে পড়েছিলেন । ইন্দিরার এসব প্রেম কাহিনি পাওয়া যায় তার জীবনী লেখিকা ক্যাথেরিন ফ্রাঙ্কের  ‘দ্য লাইফ অব ইন্দিরা নেহেরু গান্ধী’ বইতে। এছাড়া পাওয়া যায় নেহেরুর সচিব এম ও মাথাইয়ের আত্মজীবনীতেও।

আমি : হ্যাঁ, তোর কাছেই শুনেছিলাম । ১৯৩৬ সালে ইন্দিরার মা কমলা নেহেরু মারা যাওয়ার পর ইংল্যাণ্ডে পড়াশুনা করতে যান ইন্দিরা গান্ধী। সেখানে তাঁর সাথে প্রেম হয় ফিরোজ গান্ধীর আর ১৯৪২ সালে  বিয়ে করেন তাঁকে । ফিরোজ গান্ধী ছিলেন  পার্সি । এ কারণে এ বিয়ে মেনে নিতে চাননি তার বাবা জওহরলাল নেহেরু। বিয়েতে আপত্তি ছিল মহাত্মা গান্ধীরও। তবে কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনি। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সুখের হয়নি তাদের এ বিয়ে। বিবাহ বিচ্ছেদ না ঘটলেও ১৯৫০ সালের পর আর একসাথে থাকা হয়নি ফিরোজ-ইন্দিরার। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা শেষ না করেই ভারতে ফিরে আসেন তিনি। তাঁর বাবা তাকে ভর্তি করে দেন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে। সেখানে তিনি প্রেমে পড়েন এক জার্মান শিক্ষকের। ওই শিক্ষক তাঁকে জার্মান ভাষা শেখাতেন। ১৯৫০ সালে ফিরোজ গান্ধীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের পর থেকে ইন্দিরা তাঁর বাবার একান্ত সহকারী হিসেবে কাজ করতেন তাঁদের ‘তিন মূর্তি ভবনে’। এখানে  তিনি প্রেমে পড়েন তাঁর বাবার সচিব এম ও মাথাইয়ের। মাথাইয়ের সাথে তাঁর প্রেম চলে প্রায় ১২ বছর। শেষ পর্যন্ত ইন্দিরার যোগ শিক্ষক ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীর কাছে হেরে যান মাথাই। এসব ঘটনা ইতিহাসবিদ এস. গোপালের বইতে পাওয়া যায়। যেহেতু মাথাই দেখতে সুদর্শন ছিল না, সেদিক থেকে ধীরেন্দ্র ছিল অনেক বেশি সুদর্শন এক বিহারী যুবক। এরপর ইন্দিরার জীবনে আসেন দিনেশ সিং। সে প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রী ভবনে গিয়ে আড্ডা দিতো ইন্দিরার সাথে। তারপর থেকেই শুরু হয় প্রেম। দিনেশ সিং ছিলেন জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রিসভার বিদেশমন্ত্রী। এর মধ্যে ফিরোজ গান্ধীর সাথে সম্পর্ক থাকাকালেই আরো একজনের সাথে প্রেম ছিল ইন্দিরার। তার নাম মোহাম্মদ ইউনুস। কে এন রাও তার ‘নেহেরু ডায়নাস্টি’ বইতে লিখেছেন, ইন্দিরার ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী মূলত ইন্দিরা-ইউনুসের ছেলে। কারণ সঞ্জয় মানেকাকে বিয়ে করায় ইউনুস ছিল ক্ষুব্ধ। একজন শিখ মেয়ের সাথে নিজের ছেলের বিয়ে মেনে নিতে পারেনি সে। ঘটনাটি মোহাম্মদ ইউনুসের লেখা ‘পারসন, প্যাশন অ্যান্ড পলিটিক্স’ বইতেও পাওয়া যায়।  এতসব সত্ত্বেও রাজনীতিতে কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনি ইন্দিরার। 

বন্ধুনি : ধ্যুৎ, গাঁজা, পলিটিশিয়ানদের অতো সময় আছে নাকি যে প্রেম করবে !

আমি : আর কী জানিস ? ভোটারদের দ্বারা নির্বাচিত  শব্দটা একটা ফাঁকা কথা । আমাদের ইসকুল-কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর অর্থনীতির বইগুলো ফালতু । আমাদের দেশটাকে একদল  অলিগার্ক, বিগ বিজনেস আর  একটা সংকীর্ণ, স্বার্থপর, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক অভিজাতরা  হাইজ্যাক করে নিয়েছে । একটা ছোট এবং বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী যারা টাকাকড়ি লুট করার  জন্য শাসন করে । এই এলিটরা , দেশপ্রেম আর গণতন্ত্রের নামে, সমস্ত মূল্যবোধের নামে, যা একসময় প্রাচীন ভারতীয় ব্যবস্থার অংশ ছিল,  পরিকল্পিতভাবে  ধ্বংস করেছে, কোষাগার লুট করেছে, আমাদের গণতন্ত্রকে কলুষিত করেছে আর পাবলিকের মাথায় হেগেছে । 

বন্ধুনি : আচ্ছা, সারদা কেলেঙ্কারিটা কী ব্যাপার ? ওটা কি সলভ হয়ে গেছে ? নাকি ধামাচাপা পড়ে গেছে ? জানেন না ? ওটা পশ্চিমবঙ্গের একটা পনজি স্কিমের নাম । 

আমি : পনজি মানে ?

বন্ধুনি : তাও জানেন না ? পনজি  হচ্ছে এক ধরনের কূট কৌশল যেখানে নতুন বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে আদায় করা টাকা পুরনো বিনিয়োগকারীদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। চার্লস পনজি নামের এক ব্যক্তির নাম থেকে এটা চালু হয়েছে। পঞ্জি স্কিমগুলোর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করার মাধ্যমে তাদের বিনিয়োগের সর্বস্ব আত্মসাত করা। এ ধরনের স্কিম থেকে মূল পরিকল্পনাকারীই কেবল লাভবান হয়ে থাকেন। সঙ্গতভাবেই এ ধরনের ব্যবসার আইনি বৈধতা থাকে না। পঞ্জি স্কিমগুলোতে কোনো প্রকৃত পণ্য, সেবা বা ব্যবসায়িক কাঠামো থাকে না। থাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা কিছু মিথ্যা প্রতিশ্রুতি অথবা প্রস্তাবনা। সহজে অর্থ আয় করার লোভ থেকে বিনিয়োগকারীরা এর ফাঁদে পড়ে পুঁজি হারান। সাধারণ মানুষের লোভকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তি বিশেষের লাভবান হওয়ার এমন পঞ্জি স্কিমের ইতিহাস বেশ পুরনো। পঞ্জি স্কিমগুলো মূলত পিরামিড আকৃতির কাঠামোর হয়ে থাকে, যার একেবারে চূড়ায় থাকে মূল পরিকল্পনাকারীরা, যারা স্কিমটি শুরু করেন। এরপর থাকে প্রাথমিক সদস্যরা। প্রাথমিক সদস্যরা নতুন সদস্য সংগ্রহ করেন, যারা তাদের নিচের ধাপে থাকে এবং এভাবে সদস্য দ্বারা সদস্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার মাধ্যমে উপর থেকে নিচের দিকে ছড়ানো একটি পিরামিড আকারের গ্রাহক অবস্থান তৈরি হয়। এই পিরামিডের যতই নিচের দিকে যাওয়া যাবে, ততই এর আকৃতিটি ছড়ানো হয়। অর্থাৎ সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। পুরো পরিকল্পনা থেকে মূল পরিকল্পনাকারী ও প্রাথমিক সদস্যরাই কেবল লাভবান হতে পারেন। স্বল্পমেয়াদে মুনাফা সহ বিনিয়োগ ফেরৎ পাবার টোপ দেখিয়ে নতুন নতুন গ্রাহক তৈরি করা হয়। নতুন গ্রাহকরা মনে করেন, তারা যদি আরও কিছু গ্রাহককে ঘোষিত স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন তবে তার মুনাফা আরো বাড়বে। তবে পঞ্জি স্কিমগুলো থেকে গ্রাহকরা শেষপর্যন্ত ক্ষতির শিকার হয়ে থাকেন।

আমি : আমি বলছি, আমি বলছি । বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার সময়েই সুদীপ্ত সেন গুছিয়ে তুলছিলেন তাঁর বেআইনি কাজের ভিত। ২০০৯ সাল থেকে সেবি  সারদার উপর নজরদারি শুরু করে। ২০১১ সালে তারা রাজ্য সরকারকে সারদার সন্দেহজনক গতিবিধির কথা জানায়। ২০১২ সালে সেবি সারদা সংস্থাকে বিনিয়োগ সংস্থা হিসেবে কাজ না করতে বলে, কিন্তু সারদা তাতে সাড়া দেয়নি। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে সংস্থা ধসে পড়ার আগে পর্যন্ত কাজ চালিয়ে গিয়েছে তারা। ব্র্যান্ড তৈরির ব্যাপারে, জনমানসে সংস্থার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সারদা তথা সুদীপ্ত সেনের নজর ছিল সবচেয়ে বেশি। এ ব্যাপারে কাজে লাগানো হয়েছিল রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস ও সে দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন পরিচিত মুখকে। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ শতাব্দী রায়কে। সারদা গোষ্ঠীর মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করা হয় তৃণমূল কংগ্রেসের তৎকালীন রাজ্যসভা সাংসদ মিঠুন চক্রবর্তীকে । তৃণমূল কংগ্রেসের আরেক সাংসদ কুণাল ঘোষকে সারদা মিডিয়া গোষ্ঠীর সিইও নিযুক্ত করা হয়। তিনি মাসে ১৬ লক্ষ টাকা বেতন পেতেন।  আরেক তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসুর সঙ্গে সারদা মিডিয়া গোষ্ঠী ছিল ঘনিষ্ঠ। তৃণমূল কংগ্রেসের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র ছিলেন সারদা গোষ্ঠীর কর্মী ইউনিয়নের শীর্ষে ছিলেন। তিনি প্রকাশ্যেই সারদায় টাকা খাটানোর পরামর্শ দিতেন। কলকাতা পুলিশকে মোটর সাইকেল উপহার দিয়েছিল সারদা গোষ্ঠী। রাজ্যের নকশাল অধ্যুষিত এলাকায় অ্যাম্বুল্যান্স এবং মোটর সাইকেল প্রদান করে সরকার, যা স্পনসর করেছিল সারদা গোষ্ঠী। ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল সিবিআই-কে একটি চিঠি লেখেন সুদীপ্ত সেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন, বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতাদের তিনি প্রচুর পরিমাণ অর্থ দিয়েছেন। কুণাল ঘোষের চাপাচাপিতেই যে তিনি লোকসানভোগী মিডিয়া গোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করেন, এবং তাঁর ব্ল্যাকমেলের জন্যই বাজার দরের চেয়ে কম অর্থে একটি টেলিভিশন চ্যানেল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন, সে কথাও বলেছিলেন তিনি। তদন্ত শুরুর পর তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত নেতাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। সিবিআই গ্রেফতার করে সৃঞ্জয় বসু, মদন মিত্র ও কুণাল ঘোষকে। জেরা করা হয় টিএমসি সহ সভাপতি তথা রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি রজত মজুমদার, তৃণমূল যুব কংগ্রেসের প্রধান শঙ্কুদেব পাণ্ডা, সাংসদ শতাব্দী রায় এবং তাপস পালকে। মমতার নির্ভরযোগ্য সাথী, বর্তমান বিজেপি নেতা মুকুল রায়কেও জেরা করেছিল সিবিআই।সারদা কাণ্ডে সুদীপ্ত সেন গ্রেফতার হবার পর, গোটা সারদা প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ার পর, দেরাজ থেকে কঙ্কালের মত বেরিয়ে আসতে থাকে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সারদার যোগ। নাম জডায়নি, এমন কোনও নেতার সংখ্যা হাতে গোণা। আর সারা রাজ্য জুড়ে অসংখ্য তৃণমূলের ছোট-বড় নেতা কর্মীরা যে এই পঞ্জি স্কিমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাও প্রকাশ্য হতে থাকে।সারদা কেলেংকারি ফাঁস হবার পর মমতা সরকার এর তদন্তে পুলিশের এক বিশেষ তদন্তদল গঠন করে। সে তদন্তদলের শীর্ষে ছিলেন রাজীব কুমার। অভিযোগ, বিশেষ তদন্ত দল সারদার সল্টলেকে অবস্থিত অফিস থেকে বেশ কিছু জিনিস বাজেয়াপ্ত করে, যার মধ্যে ছিল একটি লাল ডায়েরি ও একটি পেন ড্রাইভ। এই দুটিতেই নাকি ছিল যেসব প্রভাশালীদের অর্থ দেওয়া হয়েছে, তাদের নাম। সিবিআইয়ের বক্তব্য সিট এই দুটি জিনিস তাদের কাছে জমা দিচ্ছে না। এ ব্যাপারে রাজীব কুমারকে সন্দেহ করে তারা। সিবিআই রাজীব কুমারের বাড়িতে তল্লাশি করতে এলে, তা প্রতিক্রিয়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গণতন্ত্র বাঁচানোর দাবিতে ৪৫ ঘন্টা ধর্নায় বসেন ধর্মতলা চত্বরে। মমতার এই প্রতিক্রিয়ার পর, লাল ডায়েরি ও পেন ড্রাইভে কাদের নাম রয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ ঘোরতর হতে থাকে। 

বন্ধুনি : আর নারদা কেলেঙ্কারি ?

আমি : পশ্চিমবঙ্গের দুটি আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা রাজ্যের মানুষকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিল। এর একটি হলো সারদা এবং অন্যটি নারদ। এই দুটি আর্থিক কেলেঙ্কারি মামলায় জড়িয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল। সরদাকাণ্ডে জড়িয়ে কারাদণ্ড ভোগও করেছেন তৃণমূলের সাংসদেরা। ম্যাথিউ স্যামুয়েল এবং তাঁর সহকর্মী অ্যাঞ্জেল আব্রাহাম, এই দুই জন মিলে আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ৫২ ঘণ্টা ব্যাপী একটি স্টিং অপারেশন চালান। এই ভিডিও ২০১৬ সালে জনসমক্ষে প্রকাশ্যে আসে। এই স্টিং অপারেশনে প্রমাণ সংগ্রহের জন্য গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করা হয়েছিল। গোপন ক্যামেরারূপী এই অস্ত্রে কিছু পরিচিত নেতাদেরই মুখ অভিযুক্ত হিসাবে জনসমক্ষে আসে। এই তালিকায় রয়েছেন, ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মদন মিত্র, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুলতান আহমেদ, অপরূপা পোদ্দার, শঙ্কুদেব পণ্ডা, আইপিএস অফিসার এস এম এইচ মির্জা প্রমুখ। এই ভিডিও ক্লিপে দেখা যায় এই তালিকাভুক্ত সবাই কিছু বিশেষ প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে টাকা নিয়েছেন। এদিকে, স্টিং অপারেশনে ব্যবহৃত ৮৫ লক্ষ টাকা ম্যাথিউ কোথা থেকে পেল, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলে, ম্যাথিউ জানান যে তিনি সাংসদ কে. ডি. সিং-এর সংস্থার থেকে পেয়েছেন। ম্যাথিউয়ের বক্তব্যকে যাচাই করতে এ বিষয়ে আবার তদন্ত শুরু হয়। এই তদন্তে, ম্যাথিউর দাবিকে খারিজ করে দেয়। এরপরে, ম্যাথিউকে অনেকবার নোটিশ পাঠানো হলেও, ম্যাথিউর তরফ থেকে কোনো প্রকারের সাড়া পাওয়া যায়নি।এরই মাঝে, একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে নারদা কান্ড নয়া মোড় নেয়। তৃণমূল দাবি করে যে, স্টিং অপারেশনের ফুটেজে তৃণমূল ত্যাগী ও বিজেপিতে যোগদানকারী মুকুল ও শুভেন্দুর ফুটেজ অনুপস্থিত। যদি বিজেপির তরফ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।উল্লেখ্য, সিবিআই-এর তরফে এই প্রথমবার নারদা মামলায় চার্জশিট পেশ করা হয়েছে। ২০১৬ সালের মার্চ মাসে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়কদের অর্থ গ্রহণের এক চাঞ্চল্যকর ভিডিও তথ্য ফাঁস করে প্রচারের আলোতে উঠে এসেছিল দিল্লির নারদ নিউজ ডট কম নামের একটি ওয়েব পোর্টাল। সেদিন তারা তৃণমূল কংগ্রেসের ওই সব নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কদের গোপনে অর্থ গ্রহণের ফুটেজ ফাঁস করে দিয়েছিল। সেই ভিডিওটি আবার কলকাতার রাজ্য বিজেপির কার্যালয়েও সেদিন ফাঁস করে দিয়েছিল বিজেপি। ওই স্টিং অপারেশনের ভিডিও ফুটেজে দেখা গিয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা ও মন্ত্রীদের ঘরে ঘরে, হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে টাকা। তাঁরা তা গ্রহণও করছেন।  

বন্ধুনি : আরেকটা হয়েছিল রোজভ্যালি কেলেঙ্কারি ? সেটাও পঞ্জি স্কিম ?

আমি : সেটা চিটফাণ্ড স্কিম । রোজভ্যালি  চিটফান্ড কাণ্ডে এবার সাজা ঘোষণার পালা। সংস্থার এক আধিকারিক অরুণ মুখোপাধ্যায়কে সাত বছরের কারাবাসের সাজা দিল নগর দায়রা আদালত। সেইসঙ্গে আড়াই লক্ষ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও ৬ মাস কারাবন্দি থাকতে হবে তাঁকে। এই প্রথমবার রোজভ্যালি সংস্থার একাধিক মামলার মধ্যে একটিতে সাজা ঘোষণা হল।ভুয়ো সংস্থার আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে বেশ কয়েকটি মামলা চলছিল রোজভ্যালির। শেয়ার ডিবেঞ্চার সংক্রান্ত একটি মামলায় সংস্থার কর্ণধার গৌতম কুণ্ডু-সহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রায় ১৩ কোটি টাকা আর্থিক তছরূপের মামলার তদন্ত করছিল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট । তাদের দেওয়া চার্জশিটে ছিল ৯ জনের নামই। এরপর চার্জ গঠনের সময়ে অন্যতম অভিযুক্ত সংস্থার আধিকারিক অরুণ মুখোপাধ্যায় নিজেই কেলেঙ্কারির দায় নিজের কাঁধে নেন। ফলে তিনি একাই দোষী সাব্যস্ত হন। শুক্রবার তাঁকে ৭ বছরের জন্য কারাবাসের সাজা শোনাল নগর দায়রা আদালত। গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইতিমধ্যে অরুণ মুখোপাধ্যায়ের ৪ বছর কারাবাসের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ফলে আর তিন বছর জেলে কাটাতে হবে তাঁকে।

বন্ধুনি : মলয়দা, সবচেয়ে কোরাপ্ট কারা জানেন ?

আমি :কারা ?

বন্ধুনি : অনেক, অনেক । সুরেশ কলমাডি ; ওনাকে মুম্বাইতে বলা হয়  ওয়ান ম্যান আর্মি। একশো কোটি টাকার বেশি একাই গেঁড়িয়েছে কলমাডি। কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারিতে তিহার জেলে ছিল ; এখন কোথায় জানি না । দুনম্বরে, আন্দিমুথু রাজা : টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির কথা মনে আছে? হ্যাঁ,  মুথু কুখ্যাত টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে ১৭৬০০০ কোটি টাকা গেঁড়িয়েছিল । জেল-ফেল হয়নি, দিব্বি জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। তিন নম্বরে মায়াবতী :  সবাই জানে যে উনি  মুখ্যমন্ত্রীর পদের অপব্যবহার করে সফলভাবে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। তাজ করিডরে রোজগার করেছেন, নিম্নবর্ণের লোকেদের কাছ থেকে টাকা তুলেছেন, লখনউতে বিশাল পার্ক করেছেন, পুরোটা সিমেন্টের, তাতে  হাতি, ওনার আর ওনার গুরুর মূর্তিতে ছয়লাপ। চার নম্বরে  লালু প্রসাদ যাদব: জোকারি করে বেশ জনপ্রিয় । পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে তিন হাজার কোটি টাকা গেঁড়িয়েছিলেন আর জেল খেটেছিলেন । জেল মানে ফাইভ স্টার হাসপাতাল। পাঁচ নম্বরে শরদ পাওয়ার:  ভারতের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা , এককালে দাউদ ইব্রাহিমের গুরু । রামগোপাল ভর্মার ফিল্মে উনি একজন ক্যারেক্টার । জাল স্ট্যাম্প মামলায় জড়িয়ে ছিলেন যার মাধ্যমে  হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করেছেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির মামলা হলেও তিনি মুক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পাক্কা খিলাড়ি। ছয় নম্বরে ভি কে শশিকলা:  সুপ্রিম কোর্ট  অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদের জন্য জেলে পাঠিয়েছিল । কর্নাটকের জেলে ছিল বলে তামিলদের পার্টি বেশ চটে গিয়েছিল । তারপর ধরাধরি করে জেলেই ভালো ঘর আর খাবার-দাবারের ব্যবস্হা হয় । সাত নম্বর জয়ললিতা: তামিলরা ডাকতো আম্মা । বেঁচে থাকতে ওনার বিরুদ্ধে ৪৬টা দুর্নীতির মামলা দায়ের হয়েছিল। কয়লা আমদানি কেলেঙ্কারি, তানসি জমির লেনদেন মামলার অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ,  আরও অনেক মামলায়  জড়িয়ে ছিলেন।আট নম্বরে বিএস ইয়েদুরাপ্পা: ঘুরেফিরে কর্ণাটকের  মুখ্যমন্ত্রী হয়, বেশ কয়েকটা জেলার  আকরিক লোহা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে  ছিল। দুর্নীতির দায়ে  মন্ত্রীর পদ খুইয়েছিল।নয় নম্বরে মধু কোডা: ভারতের সবচেয়ে দুর্নাম মন্ত্রীদের একজন। কোডার বিরুদ্ধে অবৈধ খনির ইজারা লাইসেন্স দিয়ে ঝাড়খণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণের অভিযোগ ছিল।  ক্ষমতায় থাকাকালীন জমানো সম্পদ লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাকে গ্রেফতার করে জেলে পোরা হয়েছিল। দশ নম্বরে মুলায়ম সিং যাদব: আরেকজন মহা ঘোড়েল দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী যাকে  মায়াবতীর সঙ্গে তুলনা করা হয়। যখনই অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পত্তির মামলা হয়, তখনই মুলায়ম সিংয়ের নাম উঠে আসে।

আমি : ব্যাস দশজন ? আমি তো ভেবেছিলুম একশো জনের নাম বলবে । আচ্ছা মনমোহন সিংকে কী বলবে ? আমি তাকে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করি । উনি সোনিয়া গান্ধীর  ছদ্মনামের মতো আচরণ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদকে লজ্জা দিয়েছেন। কংগ্রেসের বিপক্ষদের আক্রমণ করার জন্য  সিবিআইকে লেলিয়ে  হেয় করেছেন। অনেক কেলেঙ্কারী, অনেক বিতর্ক, কিন্তু তিনি কখনই কোন কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে করেননি। অত্যন্ত যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও উনি বোবা হয়ে সমস্ত নোংরামি সহ্য করেছেন আর একটি শব্দও বলেননি।

বন্ধুনি : আরে ওনার কথা বাদ দিন । সবাই জানে উনি নিজেকে পরিষ্কার রাখতে সফল । কিন্তু সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ছিলেন মানিক সরকার, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী, নিজের গাড়ি-বাড়ি ছিল না । টাকার জোরে বিজেপি দখল করে নিলো ত্রিপুরা রাজ্যকে ।

আমি : কোরার সাইটে কোরাপ্ট কারা জানতে চাওয়া হলে একজন এই তালিকা দিয়েছে, তুই তাদের অনেককে বাদ দিয়েছিস । লোকগুলো হলো, জওয়াহারলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধি, রাজীব গান্ধি, সোনিয়া মাইনো ( গান্ধি ), রাহুল গান্ধি, প্রিয়ঙ্কা ভদ্রা, শরদ পাওয়ার, আহমদ প্যাটেল, পি চিদাম্বরম, কপিল সিবাল, অভিষেক সংভি, কমলনাথ, সুশীলকুমার শিন্দে, দেভে গউড়া, পৃথ্বীরাজ চৌহান, বসন্তরাও দাদা পাটিল, ডি.কে. শিভকুমার, এইচ, ডি, কুমারস্বামী, হুডা, ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং ।

বন্ধুনি : সবচেয়ে ইনটারেস্টিঙ পশ্চিমবাংলার মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর চাকরি পাওয়া। ২০১৮-তে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরেই মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারী এসএসসিতে চাকরি পেয়ে যান।  প্রথমে কোনও মেধা তালিকায় অঙ্কিতার নাম না থাকলেও ওয়েটিং লিস্টে অঙ্কিতার নাম প্রথমে চলে আসে। যার জেরে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ির ববিতা সরকারের ওয়েটিং লিস্টে নাম ২০ থেকে ২১-এ চলে যায়। চাকরি হয় ওয়েটির লিস্টে ২০ পর্যন্ত। বঞ্চিত থেকে যাওয়া ববিতা হাইকোর্টে মামলা করেন। আরটিআই করে অঙ্কিতার নম্বর জানতে চান। কিন্তু কোনও উত্তরই তিনি পাননি। শেষে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নির্দেশ দিলে এসএসসির তৎকালীন চেয়ারম্যান সিদ্ধার্থ মজুমদার জানান, অঙ্কিতার বিষয় ভিত্তিক এবং অ্যাকাডেমিক স্কোর ৬১।  অন্যদিকে ববিতা সরকারের পার্সোনালিটি টেস্টে অংশ নিয়েছেন। তাঁর বিষয় ভিত্তিক, অ্যাকাডেমিক এবং পার্সোনালিটি টেস্টের স্কোর হল ৭৭। অর্থাৎ বেশি নম্বর পেয়ে বঞ্চিত রয়ে গিয়েছেন ববিতা। অঙ্কিতা অধিকারী আদালতের রায়ে চাকরি খুইয়েছেন। তাঁকে ৪১ মাসের মাইনে ফেরতের নির্দেশ দিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। 

আমি : তুই  আর্থিক কেলেঙ্কারির পাণ্ডাদের বাদ দিচ্ছিস কেন ? ওরা তো হাওয়ালার মাধ্যমে কোটি-কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে ।

বন্ধুনি : কারা ?

আমি : এক নম্বর, সত্যম কেলেঙ্কারি – ১৪০০০ কোটি । ২০০৯ সালের এই কর্পোরেট কেলেঙ্কারিটি ‘ভারতের এনরন কেলেঙ্কারি’ নামেও পরিচিত এবং এটিতে বি রামালিঙ্গা রাজু এবং তার সত্যম কম্পিউটার সার্ভিসেস লিমিটেডের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়। কোম্পানি স্বীকার করে যে তারা ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি অ্যাকাউন্টের জালিয়াতি করেছে। দুনম্বর, বিজয় মালিয়া – নয় হাজার কোটি । একটা সময় ছিল যখন মানুষ বিজয় মালিয়াকে ‘কিঙ অফ গুড টাইমস’  বলে ডাকত, কিন্তু আজ তার নামে ভালো কোনও কথা কারোর মুখ থেকেই বের হয় না। ২০১৬ সালে, মালিয়া দেশে প্রতারণা এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার পরে দেশ থেকে পলাতক হয়েছিলেন এবং ব্রিটেনে আশ্রয় চেয়েছিলেন। বিজয় মাল্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের নয় হাজার কোটি টাকারও বেশি পাওনা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।তিন নম্বর, কয়লাগেট কেলেঙ্কারি – ১.৮৬ লক্ষ কোটি ।কয়লা বরাদ্দ কেলেঙ্কারি বা ‘কয়লাগেট’ হল একটি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি যা ২০১২ সালে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সামনে আসে। কেলেঙ্কারিটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) প্রথম প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন।  তৎকালীন সরকারকে ২০০৪ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে অবৈধভাবে ১৯৪টি কয়লা ব্লক বরাদ্দ করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। যদিও CAG প্রাথমিকভাবে ১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির অনুমান করেছিল, চূড়ান্ত রিপোর্টে কেলেঙ্কারির পরিমাণ ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে।চার নম্বর,  বোফোর্স কেলেঙ্কারি – ৬৪ কোটি । এটা একটি বড় অস্ত্র-চুক্তি কেলেঙ্কারি যা ১৯৮০-৯০ -এর দশকে ভারত এবং সুইডেনের মধ্যে ঘটেছিল। ১৯৮৬ সালে, ভারত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে তাদের ১৫৫ মিমি ফিল্ড হাউইটজার সরবরাহ করার জন্য সুইডিশ অস্ত্র প্রস্তুতকারক বোফর্স এবির সাথে ১৪৩৭ কোটি টাকার (প্রায়) একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। আজকের সময়ে, বোফর্স কেলেঙ্কারির আনুমানিক পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা।পাঁচ নম্বর, নীরব মোদী পিএনবি ব্যাঙ্ক জালিয়াতি ১১,৪০০ কোটি ।পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রধান অভিযুক্ত নীরব মোদী ও তাঁর ভাইপো মেহুল চোসকি। আর্থিক দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার আগেই গত বছর জানুয়ারির শেষের দিকে তাঁরা দেশ ছেড়ে পালান।  ১৪ মার্চ ৪৮ বছরের নীরব মোদীকে গ্রেফতার করে স্কটল্যান্ট ইয়ার্ডের পুলিশ ভারতে আর্থিক তছরুপের অভিযোগে গ্রেফতার করে। ছয় নম্বর, অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার কেলেঙ্কারি- ৩৬০০ কোটি । ভারতের কুখ্যাত প্রতিরক্ষা কেলেঙ্কারিগুলির মধ্যে একটি এই প্রতারণা মামলা। এই মামলাটি ২০১০ সালের UPA সরকার এবং অগাস্টা ওয়েস্টল্যান্ডের মধ্যে ১২টি হেলিকপ্টার অধিগ্রহণের জন্য স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি যা ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য ভিভিআইপি দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল। চুক্তিটি ৩৬০০ কোটি টাকা মূল্যের ছিল।সাত নম্বর, হাওয়ালা কেলেঙ্কারি – ১৮ মিলিয়ন ডলার । হাওয়ালা কেলেঙ্কারি ১৯৯০-এর দশকে জনসাধারণের নজরে আসে, যা এল কে আডবানি, অর্জুন সিং, যশবন্ত সিনহা এবং মদন লাল খুরানার মতো রাজনীতিবিদদের এবং আরও অনেককে ঘুষের সাথে জড়িত বলে স্পটলাইট করে। এই কেলেঙ্কারীটি জৈন ভাই নামে পরিচিত হাওয়ালা ভাইদের ঘিরে তৈরি হয়েছে। 

বন্ধুনি : হাওয়ালা ব্যাপারটা কী ? কেমন কে অপারেট করে একটু বুঝিয়ে বলুন ? হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে একবার আঠারো মিলিয়ন ডলার লেনদেনের খবর পড়েছিলাম। হাওয়ালা কেলেঙ্কারি ১৯৯০-এর দশকে জনসাধারণের নজরে আসে, যা এল কে আডবানি, অর্জুন সিং, যশবন্ত সিনহা এবং মদন লাল খুরানার মতো রাজনীতিবিদদের এবং আরও অনেককে ঘুষের সাথে জড়িত বলে স্পটলাইট করে। এই কেলেঙ্কারিটিা জৈন ভাই নামে পরিচিত হাওয়ালা ভাইদের ঘিরে তৈরি হয়েছিল বলে শুনেছিলাম। 

আমি : ‘হাওয়ালা’  শব্দটা আরবি । এর মানে, লেনদেন।  পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা আর ভারতীয় উপমহাদেশে একদল দালাল আছে যারা পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে। চিরাচরিত ব্যাঙ্ক বা অর্থব্যবস্থায় যে টাকা লেনদেন হয়, হাওয়ালা হল তার সমান্তরাল  পদ্ধতি।  আগেকার কালে টাকা বা সোনা নিয়ে অনেকখানি  রাস্তা পাড়ি দেওয়া নিরাপদ ছিল না । হাওয়ালা গোয়েন্দাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কারণ, জঙ্গিরা নাশকতা চালাতে যে টাকাকড়ি যোগাড় করে কিংবা রাজনীতিবিদরা ভোটের সময় যে খরচ-খরচা করে, তার সিংহভাগ টাকা আসে এই কায়দায়। এদেশে তোলা ঘুষও বিদেশে যায় একই কায়দায় ।হাওয়ালায় একদল দালাল থাকে টাকা নেবার জন্য। এদের বলা হয় হাওয়ালাদার। ধরা যাক,  দুবাইয়ের হাওয়ালাদার কারও কাছ থেকে টাকা পেল। তখন সে যোগাযোগ করবে যেখানে টাকা পাঠাতে হবে, সেই দেশে নিজের এজেন্টের সঙ্গে। এ বার সেই এজেন্টকে টাকা পাঠানো হবে না, শুধু  ‘পাসওয়ার্ড’ দেওয়া হবে। এমন একটি শব্দ, যা মনে রাখতে হবে এজেন্টকে। যে লোকটাকে এজেন্ট টাকা দেবে, তাকেও বলে দেওয়া হবে ওই শব্দ। যার হাতে টাকাটা দিতে হবে সে ‘পাসওয়ার্ড’ এজেন্টকে বললে তবেই এজেন্ট  গ্রাহকেকে টাকাটা দেবে। প্রতিটা লেনদেনের ক্ষেত্রে হাওলাদাররা দুই শতাংশ কমিশন নেয়। মুখে-মুখে লেনদেন হয় বলে ব্যাঙ্ক বা বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রে এর কোনও প্রমাণ থাকে না। 

বন্ধুনি : হ্যাঁ। সরকারের অনেক লোকসান হয় । আবার রাজনীতিকরা আর কালোবাজারিরা হাওয়ালায় বিদেশে টাকা পাঠায় ।  ভারতে হাওয়ালা লেনদেনের ছবিটা ভয়াবহ। আইআইএম ব্যাঙ্গালোরের অধ্যাপক আর বৈদ্যনাথনের মতে, ভারত গত ছয় দশকে কর ফাঁকি বাবদ দেড় লক্ষ কোটি ডলার হারিয়েছে। আর এর ৪০ শতাংশই হয়েছে হাওয়ালা লেনদেনের কারণে। হাওয়ালা অবৈধ । হাওয়ালা নিয়ে যা আইন আছে, তা খুব কড়া। কিন্তু হাওয়ালায় এত বিপুল টাকা দেওয়া-নেওয়া হয় যে, গোয়েন্দারা এখন তা বন্ধ করতে পারেনি। বিদেশে  অনেক ভারতীয় আছে, যাঁরা ব্যাঙ্ক মারফত টাকা পাঠায় না। কারণ সংশ্লিষ্ট দেশে হয়তো বেআইনিভাবে বসবাস করছে। ব্যাঙ্কে গেলে নাম-ঠিকানা দিয়ে টাকা পাঠাতে হবে। সেক্ষেত্রে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বাড়িতে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে হাওয়ালার আশ্রয় নিতে হয়। ভারতে হাওয়ালায় টাকা লেনদেন বেআইনি ঘোষিত হয়েছে দু’টো আইন মারফত। একটা হল ফেমা বা ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট, ২০০০ অন্যটা প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট, ২০০২। 

আমি : ইনডিয়াকে আরেকজনের মাধ্যমে ডিফাইন করি, কী বলিস ?আগের অর্থমন্ত্রী পালানিয়াপ্পান চিদাম্বারামকে দুর্নীতি আর অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল।অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন সময় ঘুষ নিয়ে বিদেশী বিনিয়োগের অর্থ আত্মসাত করেছিলেন । তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে।২০০৭ সালে অর্থমন্ত্রী থাকাকালে আইএনএক্স গ্রুপের দশ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিদেশী বিনিয়োগ আত্মসাত করার অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। মি. চিদাম্বারামের ছেলে কার্তি চিদাম্বারামের বিরুদ্ধে অভিযোগ, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ঐ বিনিয়োগের ছাড়পত্র পাইয়ে দেয়ায় আইএনএক্স’এর কাছ থেকে ঘুষ পেয়েছিলেন তিনি। আর্খিক লেনদেন বিষয়ক অপরাধের তদন্ত করা সংস্থা সিবিআই এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট অভিযুক্ত দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। ২০১৮ সালে কার্তি চিদাম্বারামকে গ্রেফতার করে সিবিআই, কিন্তু পরে তাকে জামিনে ছাড়া হয়। তিনি ভারতের দক্ষিনাঞ্চলের রাজ্য তামিল নাড়ুর একজন কংগ্রেস এমপি ।

বন্ধুনি : বুঝলেন,ভারতীয় রাজনীতিকদের দুর্নীতির দায়ে শাস্তি দেওয়া খুবই কঠিন। কোনো কিছুই প্রমাণ হয় না, যদি শাসকের সঙ্গে একটু আপোস করা যায়। বোফর্সে রাজীব, হাওলায় নরসিংহ রাও, সাংসদ কেনাবেচায় শিব সোরেন, নারদা-সারদা-রোজভ্যালিতে তৃণমূল, কফিন কেলেঙ্কারিতে জর্জ ফার্নান্ডেজ, সঙ্গতিহীন সম্পদে মুলায়ম সিং বা মায়াবতী, ২জি কেলেঙ্কারিতে এ রাজা-কানিমোঝি, কমনওয়েলথ গেমস দুর্নীতিতে সুরেশ কালমাদি, গুজরাট গণহত্যায় নরেন্দ্র মোদি, সোহরাবুদ্দিন শেখ হত্যায় ও বিচারপতি লোয়ার মৃত্যুতে অমিত শাহ, কেউই দোষী সাব্যস্ত হয়নি। সকলেই ধোয়া তুলসি পাতা। ব্যতিক্রম কেবল লালু প্রসাদ যাদব। কারণ তিনি আদবানির রথ রুখেছিলেন আর সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বিজেপির সঙ্গে আপোস করেননি।

আমি : সবচেয়ে চুতিয়া টাইপের নিরক্ষর হল রাজনৈতিকভাবে  অশিক্ষিতরা । তারা শোনে না, কথা বলে না বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে না। তারা জীবনের দাম জানে না , বাজারে জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ছে জানে না, কারা বাড়াচ্ছে জানে না । আলু-পটলের দাম, মাছের, আটার দাম, ভাড়া, জুতো, ওষুধের দাম, সবই নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। রাজনৈতিক নিরক্ষর  লোকগুলো এতটাই বোকা যে তারা গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলে যে তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে। মূর্খরা জানে না যে, তাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় পতিতা, পরিত্যক্ত সন্তান আর সর্বাপেক্ষা জঘন্য চোর, রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের কোটিপতি দোস্ত।

বন্ধুনি : কারেক্ট । যে বউটা নিজের চটি খুইয়ে চটিটা ছুঁড়ে মারতে চেয়েছিল তাকে তারিফ করতেই হয় ।

আমি : হ্যাঁ, খালি পায়ে বাড়ি ফিরেছে । ওটা কিন্তু আসল ইনডিয়ার সংজ্ঞা । মাদার ইনডিয়া ।

বন্ধুনি : চটি মারার ব্যাপারটাকে নিম্নবর্ণের ক্রোধ হিসেবেও দেখা যায় । সাবলটার্ন ইনডিয়া ।

আমি : দুর্নীতি ভারতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে আর ভারতীয় সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সেঁদিয়ে গেছে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন একাডেমিয়া, ব্যবসা, ব্যাঙ্কিং, আইন প্রয়োগকারী আর অন্য রোজকার পরিষেবাগুলোয় ঘটে যাওয়া ব্যাপক দুর্নীতি আমাদের মতন মানুষের ঘাড়ে খাঁড়ার কোপের মতন নেমে এসেছে ।সামাজিক শৃঙ্খলা দুর্নীতি  সামাজিকভাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে আর অনেক ক্ষেত্রে এটা অনিবার্য আদর্শ হয়ে উঠেছে। আমি তো কলকাতা থেকে এসে ভোটার কার্ডটা ট্রান্সফার করাবার জন্য কতো দৌড়োদৌড়ি করলুম । তারপর শুনলুম যে ঘুষ না দিলে হয় না । 

বন্ধুনি :শেষ পর্যন্ত হয়েছে ?

আমি : তুই  রেশন কার্ড করিয়ে দেবার পর হয়েছে ।

বন্ধুনি : সউদি আরবে যাচ্ছো নাকি, ছেলের কাছে ? 

আমি : আরে হঠাৎ টপিক পালটে ফেললি ; এখনও তো কয়লা পাচার, গোরু পাচার, আরো নানা পাচার-কাহিনি আলোচনা হয়নি তো ! নাহ, আর কোথাও যাবো না ; ছেলেকে অবশ্য বলেছিলুম, একটা আরবি মেয়েকে বিয়ে কর, আরবের সবাই বেশ ফর্সা আর সুন্দরী, তাহলে আমরাও হজ করতে যাবো । মক্কা-মদিনা দেখা হয়ে যাবে। ও বলেছে ও আর কোনো নারীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়বে না । যাকে বিয়ে করেছিল তার গায়ে বিটকেল গন্ধ আর চেপে গিয়েছিল যে ওর ইউটেরাসে সমস্যা আছে, কোনোকালে মেন্স হয় না।

বন্ধুনি : ও বাবা, আমাদের বলেননি তো !

আমি : এসব আবার বলাবলির বিষয় নাকি । নাহ, আর কোথাও যাবো না । বিদেশের মরুভূমি দেখা হয়ে গেছে দুবাই, আবুধাবিতে, গ্র্যাণ্ড মসজিদ ঘোরা হয়ে গেছে । ইউরোপে তুষার দেখা হয়ে গেছে । যা-যা দেখার আর খাবার তা সেরে ফেলেছি। কতো মেমেন্টো জড়ো করা হয়েছে নানা দেশ থেকে, সেগুলো এখন সমস্যা । ধুলো পড়ে এমন হয়েছে যে চেনা যায় না। কলকাতা ছাড়ার সময়ে অনেক মেমেন্টো বিলিয়ে দিয়ে এসেছি আর আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছি। যেগুলো ফ্রিজে আটকানো ছিল সেগুলো ফ্রিজসুদ্ধ দিয়ে দিয়েছি । যৌবনে জড়ো করা সব জিনিস এখন ফালতু মনে হয়।

বন্ধুনি : বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির প্রবণতা নিয়ে রিপোর্ট দেয় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ৷ তাদের রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৪ সালে ভারতের দুর্নীতির র‌্যাঙ্কিং ছিল ৮৫ তম স্থানে । ২০২১ সালে ভারতের অবস্থান আরও কিছুটা নিচে নেমে গিয়েছে ৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সততার এই পরীক্ষায় ডেনমার্ক আর নিউজিল্যান্ড ১০০-র মধ্যে ৮৮ পেয়েছে ৷ আর ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ড ৮৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসবে নিজেদের প্রমাণ দিয়েছে ৷ ভারত এই পরীক্ষায় মাত্র ৪০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে ৷ সারা বিশ্বে এই গড় ৪৩ শতাংশ৷ আর এই ক্ষেত্রে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১ টি দেশের গড় ৪৫ শতাংশ । ভারতের র‌্যাঙ্কিং এশিয়া-প্যাসিফিক গড়ের চেয়ে অনেক খারাপ । চিন ৪২ নম্বর পেয়ে ৭৮তম স্থান জায়গা করে নিতে পেরেছে৷ কোরোনা প্যানডেমিক কেবলমাত্র একটি অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য বিপর্যয়ই নয়, এটি দুর্নীতিও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ৷ 

আমি : জানি ।

বন্ধুনি : আরেকটা নতুন টার্ম শুনছি, কাটমানি। সেটা কী ? 

আমি : তুই জানিস না ? পশ্চিমবঙ্গের সমসাময়িক পরিস্থিতি বলছে, ‘কাটমানি’ হল সেই টাকা যা কোনো সরকারি প্রকল্পের অনুমোদন দিতে বা পরিষেবা পাইয়ে দিতে জনপ্রতিনিধি, মানে দাপুটে নেতার হাতে তুলে দিতে হয়। অর্থাৎ, সরকার নির্ধারিত মোট টাকা থেকে যে টাকা ‘কাট’ করে কাজের স্বার্থে প্রভাবশালীর হাতে তুলে দিতে হচ্ছে, সেটাই ‘কাটমানি’। মোদ্দাকথা হচ্ছে কোন সরকারি অর্থ বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের মধ্যে সাহায্য হিসেবে বিতরণ করতে হলে এই উক্ত শ্রেণীর মাধ্যমে অর্থাৎ— ফুলনেতা, হাফনেতা , টেপিনেতা, ফুটিনেতা এনাদের হাতে কাটমানি হয়ে অবশেষে যতকিঞ্চিত, যার নামে সকারী খাতায় টাকাগুলো মঞ্জুর হয়েছে এর হাতে এসে পৌছায়।উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, কোনো সরকারি প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ ১০০ টাকা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি গ্রাহককে জানালেন, ওই টাকা পাওয়ার অনুমোদন পেতে তাঁকে ২৫ টাকা ‘চার্জ’ জিতে হবে। এই টাকা বেশির ভাগ সময়ই নিচু তলার রাজনীতিক থেকে উঁচু তলায় স্তরে স্তরে পৌঁছে যায়।

বন্ধুনি : সিন্ডিকেট ? সেটাও তো পশ্চিমবাংলার অবদান । কিন্তু ইনডিয়াকে ডিফাইন করে আই থিংক ।

আমি : সিন্ডিকেট নামের রাক্ষসগুলোর জনক কারা , এই প্রশ্ন তুললে দলগুলোর মধ্যে চাপানওতোর চলে । বামপন্থীরা বলে, তাঁদের জমানায় রাজারহাটে কো-অপারেটিভ ছিল ।  তৃণমূল কংগ্রেস এসে  সিন্ডিকেট ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে । তৃণমূল কংগ্রেস বলবে, তারা উত্তরাধিকার সূত্রে ব্যবস্থাটা পেয়েছে । কেন প্রতিটি দলই পশ্চিমবঙ্গে সিন্ডিকেট বা সেরকম ব্যবস্থাকে তোল্লাই দেয়, সেই প্রশ্নের উত্তর আছে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থায়। পশ্চিমবঙ্গে বড়ো শিল্প নেই, ফলে বড় মাপের কর্মসংস্থানও নেই। যা আছে,  তা প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব ।  এই অবস্থায়  রাজনৈতিক প্রতিপত্তি ব্যবহার করে কনট্রাক্টরদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে একটা দল । যে হেতু পশ্চিমবাংলায় চাকরি-বাকরি নেই তাই  রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে সিন্ডিকেটে কাজ করতে হয় বেকার ছেলেদের । আবার, তাদের হাতে রাখতে চায় রাজনৈতিক দলগুলো । ফলে, সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় না দিয়ে  উপায় নেই।  এক নেতা একবার বলেছিলেন, সিন্ডিকেটের গায়ে হাত পড়লে সরকার পড়ে যাবে ।  সিন্ডিকেট থেকে বাড়ি তৈরির মাল আর শ্রমিক নিতে হয় । না নিলে বিপদ । চাকরির সমস্যার সমাধান না হওয়ায়  এই রাজনৈতিক হাতিয়ার প্রয়োগ করতে হয়। সিন্ডিকেটের নামে  জুলুম চলে। 

বন্ধুনি : সিন্ডিকেট ব্যাপারটা ঠিক কী ? একটু বুঝিয়ে বলুন ।

আমি : সিন্ডিকেটের একেবারে প্রাথমিক ধাপ হল, যখন কোনও পার্টির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন প্রোমোটাররা, তাঁকে সেই ওয়ার্ডের প্রভাবশালী নেতাকে ‘প্রণামী’ দিতে হয়, মানে মোগল আমলের সেই নজরানা। কী সেই ‘নজরানা’? দমদম সংসদীয় এলাকায় জায়গা বুঝে একটা থোক টাকা, সেটা দু’লক্ষ,তিন লক্ষ কিংবা তারও বেশি হতে পারে। তারপরের ধাপ হল সিন্ডিকেটের বরাত। এখন এই মুহূর্তে দমদম এলাকায় সেই রেট চলছে ৩৫০-৩৭০ টাকা স্কোয়্যার ফিট। প্রোমোটারদের কথায়, এতে আবার রয়েছেন সেই দাদা-দিদিদেরই অনুগামীরা। তাঁদেরকে সেই টাকা দিতে হয়। তাঁরাই মূলত ইট-বালি-সিমেন্টের বরাত পান। এর অবশ্য বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। প্রমোটারদের চলতি কথায়, তা হল ‘সিন্ডিকেট কেনা’। এই অনুগামীদের বরাত না দিয়ে তাঁদেরকে একটা থোক টাকা দিয়ে দেওয়া হল। একেবারে কর্পোরেট কায়দায় চলে সিন্ডিকেট রাজ। কাউন্সিলরদের মধ্যেই যে সিন্ডিকেট নিয়ে বিবাদ তুঙ্গে, তা তাঁর কথাতেই স্পষ্ট। আর এরই ফায়দা লুঠছে এক শ্রেণির মানুষ।

বন্ধুনি : সরকার কনট্রোল করলেই তো পারে ?

আমি : সিন্ডিকেটকে কেন কনট্রোল করা উচিত, সেই প্রশ্নের একরকম উত্তর রাজারহাটে পাওয়া গেলে অন্যরকম উত্তর পাওয়া যাবে হলদিয়ায়। এক দিকে যেমন সিন্ডিকেটের জুলুমে বাড়িটাড়ি তৈরির খরচ বেড়ে যায়, ফলে ফ্ল্যাটের দাম ন্যায্য স্তরের তুলনায় বেশি হয়, অন্য দিকে বাড়ি তৈরির গুণমানও  ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, বাজারে  চাহিদা পড়ে যায়। তার প্রভাব পড়ে কাজে, ইঁট-বালি-সিমেন্ট-লোহার  সার্বিক চাহিদায়। অন্য দিকে, হলদিয়ার অভিজ্ঞতা বলবে, এই সিন্ডিকেটের জুলুমে এক বহুজাতিক সংস্থা বন্দরের কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হল, আর তার ফলে বন্দর-বাণিজ্যের একটি বড় অংশ চলে গেল প্রতিবেশী রাজ্যে। মানে, সিন্ডিকেটের জুলুমে যে শুধু কনট্রাক্টারের ক্ষতি হয়, তাই নয়— ক্ষতি হয় পুরো  রাজ্যের । সিন্ডিকেট প্রথা কনট্রোল করা অসম্ভব হয়ে গেছে । 

বন্ধুনি : প্রতিটি নির্বাচনের আগেই তোলাবাজি, কাটমানি ও সিন্ডিকেট নিয়ে হুঁশিয়ারি দেবে প্রশাসনের শীর্ষ মহল। বিরোধীরাও গলা চড়াবেন। ঠিক যেমন গত বুধবার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের ভাবী কাউন্সিলরদের সিন্ডিকেট ও তোলাবাজি নিয়ে হুঁশিয়ারি দেন। কিন্তু তাতে পরিস্থিতি বদলাবে কি? আরও এক নির্বাচনের আগে সেটাই প্রশ্ন। ভুক্তভোগীদের বক্তব্য, গত ভোটে মমতা কাটমানির টাকা ফেরত দিতে বলার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। দিনকয়েক চুপ ছিলেন নেতা-দাদারা। শোরগোল থিতিয়ে যেতেই যে কে সে-ই! পুরভোটের পরেও তেমনটাই হতে পারে। তাঁদের অভিযোগ, পুর পরিষেবার মাধ্যমেই বছরভর সব চেয়ে বেশি টাকা কামানোর কারবার চলে। মমতাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিষয়টি তাঁর অজানা নয়। জনসভায় তিনি বলেন, ‘‘আমার এলাকায় কেউ ঘরবাড়ি করলে সমস্ত কিছু আমার থেকে কিনতে হবে, তা হবে না। কেউ ঘরবাড়ি করলেই আমাকে এত টাকা দেবে, তা-ও হবে না।

আমি :  এটা অক্সিমোরোন । গণতন্ত্র চাই । তাকে টিকিয়ে রাখতে অঢেল টাকা চাই ।

বন্ধুনি : আর তোলাবাজি ? কতোরকমের টার্ম যে ইনডিয়াকে ডিফাইন করে তার ইয়ত্তা নেই মাইরি ।

আমি : জানিস না ? তোলা মানে চাঁদা । বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বা রাস্তায় গাড়িটাড়ি থামিয়ে, চাঁদা আদায় । আজকাল বাজারে চাঁদা তোলার রসিদও বিক্রি হয় । রসিদ দেখিয়ে দিলে সন্দেহ কম হয় । তবে আবদার বদলে গিয়েছে হুকুমে। খুদেদের সরিয়ে ঢুকে পড়েছে বড়রা। দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে একই সারিতে ঢুকে পড়েছে সরস্বতীও। সৌজন্যে চাঁদার জুলুম। আর তার ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সম্প্রতি হাঁসখালির ফুলবাড়িতে চাঁদার জুলুমবাজিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল কৃষ্ণগঞ্জের বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাসের। অভিযোগ, তাঁর অনুগামীরা এক ট্রাক চালক ও খালাসিকে গাড়ি নিয়ে তাড়া করে বেধড়ক মারধর করে। গুরুতর জখম অবস্থায় ওই দু’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। তাঁদের ‘অপরাধ’ ছিল সরস্বতী পুজোর উদ্যোক্তাদের দাবি মতো তাঁরা চাঁদা দিতে পারেননি।

বন্ধুনি : আপনি তো গায়ক হতে চেয়েছিলেন ! ইনডিয়ার ল্যাঙ খেয়ে গেলেন ?

আমি : ঘায়ে খোঁচা দিস না । যারা  সাহিত্য, সঙ্গীত, ব্যবসা, রাজনীতি, খেলাধুলো, শিল্পকলা ইত্যাদিতে সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়ার স্বীকৃতি লাভ করে — তাদের সবচেয়ে প্রতিভাবান মনে করার কারণ নেই। আমাদের মধ্যে অগণিত মানুষ আরও বেশি গুণ সম্পন্ন হলেও, তাদের বিকাশের সুযোগ, বাজারের সমর্থন বা সম্পদের অভাবে তারা ঢাকা পড়ে যায়। যদিও সাফল্য আর প্রতিভার মধ্যে সম্পর্কটা অস্পষ্ট,  গণসমাজ একটা মেধাতান্ত্রিক আদর্শকে সমর্থন করে, যা উল্টোটায় জোর দেয়, মানে যারা সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছে, তারা সর্বদা সবচেয়ে প্রতিভাবান। এর ফল বিষময়। সফলতা  যাদের গণমানসে এড়িয়ে যায়, তারা কেবল ব্যর্থতার  আঘাতগুলোকে সহ্য করে না,  তাদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার অপমানও সহ্য করতে হয়, কারণ তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগ, বাজারের  সমর্থন আর সম্পদ নেই।

বন্ধুনি : কথাটা ঠিক । আচ্ছা গরু পাচারেও নাকি পলিটিশিয়ানদের হাত আছে ? দেশে গোমাংস বিরোধী একটা উন্মাদনা যেমন ধর্মনিরপেক্ষতার সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করছে, তেমনই খাদ্য নির্বাচনের স্বাধীনতা হরণকেও আন্তর্জাতিক কূটনীতি ভাল চোখে দেখে না। নিজের সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি কারও উপর চাপানো ঠিক নয়। জাতীয় স্বার্থে রাজনীতি ও কূটনীতি পরিচালিত করার বদলে ‘এক ধর্ম, এক ভাষা, এক খাদ্য’কে সামনে আনা হচ্ছে, যার অর্থ হল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সহিষ্ণুতার আদর্শকে বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে । সাম্প্রতিক কালে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন আর আগে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং যখন ভারতে এসেছেন, তখন তাঁদের নিরামিষ খেতে দেওয়া হল, যা রুশ ও চিনা অতিথিরা ভাল ভাবে নেননি।

আমি : ভোট রাজনীতির সুবিধা তোলার জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদের ব্যবহার করে শাসকদল এবং তাদের ধ্বজাধারীরা সমাজের জটিল ভারসাম্য নষ্ট করছে এবং এর ফলাফল যে কী হতে পারে, সেটি সম্পর্কে তাঁদের কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। এই ঘটনাপ্রবাহ এখনও পর্যন্ত যথেষ্ট স্থিতিস্থাপকতার পরিচয় দিয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ১৯৯০-এর দশকে মুসলিম মৌলবাদের জোয়ারের সময়ে ভারতীয় মুসলমানরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চরমপন্থার ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হননি। কিন্তু বর্তমানে এই মানুষেরা ক্রমাগত পক্ষপাত এবং শাসানির শিকার হচ্ছেন। এই আক্রমণ তাঁরা আর কত দিন সহ্য করতে পারবেন, তা স্পষ্ট না হলেও ভারতীয় গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিতে ভাঙন ধরানোর ফলাফল যে মারাত্মক হবে, সে কথা বলাই বাহুল্য।

বন্ধুনি : মুসলমানদের অবস্থাও শোচনীয়। তথাকথিত গো-রক্ষা গোষ্ঠীর লোকজন দ্বারা নির্যাতন এবং খুনের একাধিক ঘটনার পরে বর্তমানে মুসলমানদের নিধন করার জন্য খোলাখুলি ভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে। গুরুগ্রামে মুসলমানদের শুক্রবারের নমাজ পাঠ বন্ধ করার জন্য ধারাবাহিক প্রচার চালানো হচ্ছে। এই মুহূর্তে দেশের সর্বাধিক আধিপত্য বিশিষ্ট মতবাদ, ‘হিন্দুত্ব’, সম্পূর্ণ অশিক্ষিত না হলেও প্রকৃত ইতিহাসের এক অর্ধশিক্ষিত ধারণার উপরে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে একটি উদ্ভট মতবাদ গড়ে তোলা হচ্ছে যে, বর্তমানে দেশের মুসলিম অধিবাসীরা ব্যক্তিগত ভাবে সেই সকল নৃশংসতার জন্য দায়ী যা আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে কোনও মুসলমান শাসক বা আক্রমণকারী দ্বারা করা। খ্রিস্টান জনসেবামূলক কাজ এবং বিদ্যালয়গুলির উপরে ধর্মান্তরকরণের অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু দেড়শো বছর ব্রিটিশদের ‘খ্রিস্টান’ শাসনের পরেও কেন এ দেশের মাত্র ২% মানুষ এই ধর্মাবলম্বী সে বিষয়ে কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি।

আমি : বেড়ে চলা অসহিষ্ণুতার অভিযোগে ভারতের সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, অভিনেতারা সোচ্চার হয়ে উঠছেন৷ দলমত নির্বিশেষে লেখকরা দলে দলে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন৷ অথচ সরকার এর পেছনে রাজনৈতিক চক্রান্ত দেখছে৷ হিন্দুত্ববাদীদের রোষের মুখে প্রাণ দিতে হয়েছে কর্ণাটক রাজ্যের শিক্ষাবিদ কালবুর্গি থেকে শুরু করে উত্তর প্রদেশের দাদরিতে মহম্মদ আখলাককে৷ সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ, সমাজকর্মী গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর আর যুক্তিবাদী এমএম কালবুর্গী হত্যার মধ্যে  যোগাযোগ আছে, সেকথা সবাই জানে।

বন্ধুনি : ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কিছু না কিছু ভিন্ন সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়ের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা এবং বিয়ে হচ্ছে৷ মৌলবাদী হিন্দুরা যার নাম দিয়েছে ‘লাভ জিহাদ’৷ প্রথমদিকে নাম ছিল রোমিও জিহাদ৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা কিছুতেই এই‘লাভ জিহাদ’ মেনে নিতে পারছে না৷ কেন পারছে না ? কারণ, এটা তাদের মতে, ধর্মান্তর করা ছাড়া আর কিছুই না৷ এই অভিযোগে হিন্দু-মুসলিম দম্পতির বাড়িতে গিয়ে চড়াও হচ্ছে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল বা সংঘ পরিবারের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ৷ তাদের নানাভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে৷

আমি :  ‘মৌলবাদ’ শব্দটার ব্যবহার বিগত শতাব্দীতে এমন কি এই বিংশ  শতাব্দীর প্রথমার্ধেও আদৌ হয়েছিল বলে মনে হয় না। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্ৰ বা রবীন্দ্রনাথ–বাংলা ভাষা ও সাহিত্য যাদের হাতে শৈশব পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছিল, তাঁরা ধর্ম, ধর্মীয় গোড়ামি, ধর্মীয় কুসংস্কার, ধর্ম সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি প্রসঙ্গে বহু আলোচনা করলেও তাদের লেখায় কোথাও মৌলবাদ শব্দটি সাধারণভাবে চােখে পড়ে না। এটি অবশ্যই ঠিক যে, তাদের প্রতিটি লেখা খুঁটিয়ে পড়ে তারপর এমন মন্তব্য করা হচ্ছে তা নয়। উপযুক্ত গবেষক ও মনোযোগী পাঠক এ ব্যাপারে আলোকপাত করতে পারবেন। তবে এতে অন্তত কোন সন্দেহ নেই যে, বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে (বিশেষত আশির দশকের শেষার্ধ থেকে, রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্কের প্রসঙ্গে) বাংলা ভাষায় এই শব্দটি পূর্বেকার কয়েক শত বছরের তুলনায় এত বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে যে, শব্দটির উদ্ভবই এই সময়ে ঘটেছে বলে বলা যায়।

বন্ধুনি : আমাদের এই সংস্কৃতির ভিত্তি বা উৎস ধর্ম নয়, বরং লোকায়ত চিন্তা ও ভাবাদর্শ, যা প্রজন্ম–পরম্পরায় চলে আসছে। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত। শুধু আধুনিক লিখিত সাহিত্যে নয়, পালা, পল্লিগান, যাত্রা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এক সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রকাশ ও বিস্তার আমরা দেখি, যার মধ্যে কিছু ধর্মীয় বিষয় ও কখনো কখনো রাজপুরুষদের কাহিনি থাকলেও (মহাকবি ও শ্রেষ্ঠ নাট্যকার শেক্‌সপিয়ারের নাটকেও রাজরাজড়ার ও ভূত-প্রেতের কাহিনি আছে,  মর্মবস্তুর মধ্যে যা প্রধান ছিল, তা হলো মানুষের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও উদারপন্থী মতবাদ। ঐতিহাসিক সুজিত আচার্য ‘বাংলায় ইসলাম ধর্মের আদিপর্ব’ নামক রচনায় বলেছেন, এ দেশে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল তরবারির জোরে নয়, বরং সুফি মতবাদী ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা। তাঁদের মতবাদের সঙ্গে এই দেশের শোষিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তাদের সহজিয়া মতবাদের অনেক সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছিল। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের অনেক আগেই যে বৌদ্ধধর্মের সহজিয়া মতবাদ ও বেদবিরোধী লোকায়ত দর্শন জনমনে গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছিল, তার মানবিক দিক ছিল ।

আমি : কর্পোরেট বাজারও মৌলবাদ, তা ভুললে চলবে না ।  ধরে নেয়া হয় যে বাজারের সর্বোচ্চ ব্যবহার সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতাকে উন্মুক্ত করবে আর  ফলাফল হবে আরো ভালো পণ্য, আরো বেশি বিক্রি, আরো বেশি মুনাফা আর এজন্য সবকিছুই বৈধ। এই প্রতিযোগিতার প্রভাব কার উপর কেমন পড়লো কিচ্ছু যায় আসে না। বর্তমানের তথাকথিত ‘মুক্ত বাণিজ্য’র আদর্শ এই নয়া-উদারনীতিকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চায়। এই বাজার মৌলবাদে এটি প্রায় একটি বিশ্বাস হিসাবে ছড়িয়ে দেয়া হয় যে বাজারের অদৃশ্য হাত সবসময়ই ভালো ফলাফল বয়ে আনবে। বাজার মৌলবাদ কার্যত পুরুষতান্ত্রিক। পুঁজিবাদ কার্যত পুরূষতন্ত্রের একটি রূপ। নারীবাদীদের অনেকেই বলেছেন পুঁজিবাদ এবং পিতৃতন্ত্র সম্পূর্ণ একদেহ না হলেও দুই-এর সম্পর্ক নিবিড়। পুঁজি আর পিতৃতন্ত্রের যৌথতায় নারীর অধঃস্থনতার আধুনিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। 

বন্ধুনি : বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে হওয়া লোহাচুর কেলেঙ্কারির বিপুল আর্থিক দায় নিতে হল তৃণমূল কংগ্রেস সরকারকে। বাম আমলে চীনে আকরিক লোহা রপ্তানির জন্য নেওয়া ঋণের বকেয়া (সুদ ও আসল মিলিয়ে) বাবদ ১৮৫ কোটি ৮৩ লক্ষ ৭৩ হাজার ৫৩০ টাকা ন’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে সোমবার মিটিয়ে দিল খাদ্য দপ্তর। এই দপ্তরের অধীনস্থ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ নিগম (ইসিএসসি) ২০০৫ সালে লোহা আকরিক রপ্তানির জন্য ন’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কনসোর্টিয়ামের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিল। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে লোহা আকরিক রপ্তানি করা হয়েছিল। কিন্তু চীন পর্যন্ত ওই লোহা পৌঁছায়নি বলে অভিযোগ। এই ঋণ মেটানোর জন্য বিপুল চাপ ছিল খাদ্য দপ্তরের উপর। ঋণ পরিশোধ না করে কোনও উপায় ছিল না। কারণ চলতি অক্টোবর মাসের মধ্যে এই টাকা পরিশোধ না করলে ইসিএসসি-কে দেউলিয়া ঘোষণা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেত। সংস্থার ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলির লেনদেন বন্ধ হয়ে যেত। চলতি বছরেই এটা করা হয়েছিল। তখন খাদ্য দপ্তরের অনুরোধে ছ’ মাস অ্যাকাউন্টে লেনদেন করার অনুমতি দেওয়া হয়। সেই সময়সীমা শেষ হচ্ছে অক্টোবরে। ২০১৬ সালের নতুন কেন্দ্রীয় আইনে ‘কর্পোরেট ইনসলভেন্সি রেজুলিউশন প্রসেস’-এর মাধ্যমে ঋণ পরিশোধের প্রক্রিয়া চলছিল।  সরকারি উদ্যোগে চাষিদের কাছ থেকে ধান কেনার মূল দায়িত্ব ইসিএসসি-র। নভেম্বর মাস থেকে এই কাজ শুরু হবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেলে ধান কেনার কাজই থমকে যেত। শুধু তাই নয়, দেউলিয়া ঘোষণা হওয়ার পর ইসিএসসি-র স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি নীলাম করে বকেয়া টাকা আদায় করতে পারত ব্যাংকগুলি। তাই আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও টাকা মেটাতে হয়েছে। এর জন্য নতুন করে ব্যাংক ঋণ নিতে হয়েছে নিগমকে। ঋণের গ্যারান্টার হয়েছে খাদ্য দপ্তর। গত বেশ কয়েক মাস ধরে ঋণ মেটানোর জন্য ব্যাংকগুলির সঙ্গে আলোচনা চলছিল। রাজ্য সরকার চেয়েছিল সুদ ছাড়া বকেয়া ঋণের আসল অংশটুকু পরিশোধ করতে। তা হলে ১৫৬ কোটি ৯৫ লক্ষ টাকা দিতে হত। কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলি তাতে রাজি না হওয়ায় একসঙ্গে প্রায় ১৮৬ কোটি টাকা দিতে হল। পুরো ঘটনায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তিনি বলেন, বামফ্রন্ট সরকারের সময় রাজনৈতিক মদতে চলা ‘লুটপাটের’ গুনাগার দিতে হল তাঁদের সরকারকে। লোহাচুর কেলেঙ্কারির টাকার ভাগ বামফ্রন্টের বড়-ছোট শরিকদের কাছে গিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি প্রাক্তন মন্ত্রী নরেন দে-র দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। টাকা পরিশোধ করার জেরে দপ্তরের উন্নয়নমূলক কাজ কিছুটা ব্যাহত হবে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন। লোহা আকরিক কেলেঙ্কারির তদন্তে আরও গতি আনার জন্য সিআইডি-কে খাদ্য দপ্তরের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। লোহাচুর কেলেঙ্কারির মামলায় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে সিআইডি একমাত্র জেরা করেছিল প্রবীণ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা নরেন দে-কে। তিনি খাদ্য দপ্তরের মন্ত্রী ছাড়াও ইসিএসসি-র চেয়ারম্যান পদে ছিলেন। জ্যোতিপ্রিয়বাবু রাজনৈতিক মদতের যে অভিযোগ তুলেছেন, সেই প্রসঙ্গে নরেনবাবু এদিন বলেন, সিআইডি তো আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। আমি লিখিতভাবে তাদের নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলাম। সিআইডি তাতে সন্তুষ্ট হয় বলে প্রাক্তন মন্ত্রীর দাবি। নরেনবাবু দাবি করেন, তিনি যখন সমবায় দপ্তর থেকে খাদ্য দপ্তরের দায়িত্বে আসেন, তখন লোহাচুরের বিষয়টি ‘ক্লোজড চ্যাপ্টার’ হয়ে গিয়েছে। খাদ্য দপ্তরে তাঁর পূর্বসূরি প্রয়াত কলিমুদ্দিন শামসের সময়ে লোহাচুর রপ্তানির বিষয়টি হয়েছিল বলেও তিনি দাবি করেছেন। এই মামলার তদন্তে খাদ্য দপ্তর আরও গতি আনতে চাইছে। এ প্রসঙ্গে নরেনবাবু বলেন, যা ইচ্ছা তাই করুক। লোহাচুর কেলেঙ্কারির ঘটনায় সিআইডি ইতিমধ্যে আদালতে একাধিক চার্জশিট পেশ করেছে। মামলার শুনানিও চলছে। এই মামলায় তৎকালীন নিগমের শীর্ষ পদে থাকা দুই আইএএস আধিকারিক দেবাদিত্য চক্রবর্তী ও এস সি জামির গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। 

আমি : ইসলামী মৌলবাদকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে মুসলমানদের একটি আন্দোলন হিসেবে  যারা অতীতকে ধারণ করে এবং ধর্মের মূলে ফিরে যেতে  চায় এবং একইভাবে জীবনযাপন করে যেভাবে নবী মুহাম্মদ   ও তার সাহাবীগন জীবনযাপন করতেন। ইসলামী মৌলবাদীরা ইসলামের প্রাথমিক উৎস (কুরআন ও সুন্নাহ) এর “আক্ষরিক এবং মৌলিক ব্যাখ্যা” সমর্থন করে, এবং তাদের জীবনের প্রতিটি অংশ হতে, তাদের ধারণা আনুযায়ী “বিকৃত” অনৈসলামিক প্রভাব দূর করতে চায় ।

বন্ধুনি: ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাচার একটি দীর্ঘ দিনের সমস্যা। মূলত এ ক্ষেত্রে ‘ট্রানজিট পয়েন্টে’র কাজ করে পশ্চিমবঙ্গ। বিএসএফ সূত্রে বলা হয়েছে, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলি থেকে চোরা পথে গরু এসে পৌঁছয় পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলিতে। এর পর রাতের অন্ধকারে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা দিয়ে ওই গরু বাংলাদেশে পাচার হয়ে যায়। পাচারকারীদের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, ও বিএসএফের একাংশ জড়িয়ে রয়েছে বলেও অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। তবে পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টায় দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর। পাচার রুখতে সক্রিয় হয় কেন্দ্র। বিএসএফের দাবি, সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোয় আগের চেয়ে গরু পাচার অনেক কমেছে। ২০১৩-১৪ সালে প্রায় কুড়ি লক্ষ গরু পাচার হয়েছিল। বিএসএফের যুক্তি, পাট গাছের দৈর্ঘ্য সাত থেকে দশ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। ওই উচ্চতাকে কাজে লাগায় গরু পাচারকারীরা। পাটগাছের উচ্চতার কারণে ক্ষেতের ভিতর দিয়ে গরু নিয়ে পালালে চোখে পড়ার সম্ভাবনা কম। রাতের অন্ধকারে দূর থেকে আলো ফেললেও ক্ষেতের মধ্যে থাকা গরুদের গতিবিধি বোঝা সম্ভব হয় না। অন্য স্থানে নজরদারি বাড়ানোয় এখন অধিকাংশ গরু পাচারের ঘটনা পাটের ক্ষেতের মধ্যে দিয়েই হচ্ছে। বিএসএফের ডিজি ডি কে পাঠক বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই পাচারকারীদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ওই এলাকায় পাট চাষ হয়ে থাকে। তাই সীমান্ত এলাকায় পাট চাষ বন্ধ করার জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন করেছি।’’ বিএসএফ চাইছে, কেন্দ্র যেন বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আলোচনা করে পাটচাষিদের বিকল্প চাষের ব্যবস্থা করে দেয়।

আমি : তুই বোধহয় জানিস না, কলা গাছের ভেলা বানিয়ে গরুকে সেটার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে শুধু মাথা জলের ওপরে ভেসে থাকে। আর এভাবেই গরুগুলোকে ভাসিয়ে দেওয়া হয় নদীর জলে। গরু পাচারের অভিনব আর নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করছে গরুপাচারকারীরা। মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান সীমান্ত লাগোয়া বীরভূমের বেশ কয়েক’টি জায়গা থেকে ফের পাচার শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর অভিযোগ। সম্প্রতি মুরারই ২-এর বিডিও-র কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। লিখিত অভিযোগের পেয়ে বিডিও কৃষ্ণকান্ত ঘোষ পুলিশের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন। পাচার রুখতে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীও। বাংলাদেশ লাগোয়া জেলা-সীমান্তের অর্থনীতি চার পায়ে হাঁটে, বিধানসভা ভোটের আগে সেই তত্ত্বই বীরভূমে ফের স্বমহিমায়। এলাকাবাসীর মত, সীমান্ত এলাকায় পুলিশ-বিএসএফের যৌথ নজরদারির জেরে কয়েক মাস কিছুটা হলেও গরু পাচারে ভাটা পড়েছিল। তবে পাচার কখনই থেমে থাকেনি বলে অভিযোগ। ইদানীং সেটাই আড়ে-বহড়ে বাড়তে শুরু করেছে বলে মত এলাকাবাসীর। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই বলছেন, ‘‘মুরারই-মিত্রপুর রাস্তার উপর দিয়ে দিনের আলোয় গরু হাঁটিয়ে পার করানো হচ্ছে। পুলিশকে ফোনে সে সব জানানো সত্ত্বেও তৎপরতা নজরে আসেনি।

বন্ধুনি : কয়লা পাচার ?

আমি : খনি অঞ্চলে বেআইনি কয়লা খনন চলছে দীর্ঘ দিন ধরেই। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মূলত তিন পদ্ধতিতে এই কয়লা চুরি চলে। প্রথমত, ইসিএল বা ব্যক্তি মালিকানার জমিতে অবৈধ খাদান তৈরি করে কয়লা তোলা হয়। দ্বিতীয়ত, ইসিএলের বন্ধ বা চালু খোলা মুখ খনিতে গভীর সুড়ঙ্গ (স্মার্ট হোল) বানিয়ে কয়লা তোলা হয়। তৃতীয়ত, ইসিএলের কয়লা ডম্পার বা রেলের পরিবহণের সময়ে কয়লা নামিয়ে নেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, আসানসোল-দুর্গাপুর পুলিশ কমিশনারেট গঠনের পরে ইসিএল বা ব্যক্তি মালিকানার জমিতে খাদান তৈরি করে কয়লা তোলা কমেছে। কিন্তু অন্য সব পদ্ধতিতে এখনও চুরি চলছে।বারাবনির জামগ্রাম, গৌরান্ডি, মদনপুর, সরিষাতলি এলাকাতেও অবৈধ কয়লার কারবার রমরম করে চলছে বলে এলাকা সূত্রে জানা যায়। যার জেরে মাঝে-মধ্যে ধসের ঘটনাও ঘটছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। স্থানীয় তৃণমূল নেতা পাপ্পু উপাধ্যায় দাবি করেন, বামেদের সময় থেকে চলে আসা এই অবৈধ কারবার চলছে এখন কিছুটা রোধ করা গেলেও পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। পাপ্পু বলেন, “আমরা পুলিশের কাছে এই চুরি বন্ধের দাবি করেছি। তা না হলে এক দিন সবাই তলিয়ে যাব।” জামুড়িয়ার কাটাগড়িয়া জঙ্গল, পরিহারপুর ।

বন্ধুনি : পুলিশ ধরপাকড় করে না ?

আমি : আরে, গরু ও কয়লা পাচার কান্ডে এবার রাজ্যের ৬ পুলিশকর্মীকে নোটিস পাঠাল সিবিআই  । তাদের মধ্যে একজন ডিএসপি পদ মর্যাদার অফিসার ও রয়েছেন। ডিসেম্বর মাসে গরু পাচারকারী তদন্তের ডিআইজি সহ বিএসএফের ৪ অফিসারকে নোটিশ পাঠায় সিবিআই। যে চারজনকে নোটিস পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন ডিআইজি ছিলেন। উল্লেখ্য কয়েক মাস ধরেই কয়লা গরু পাচারকা কান্ডে তৎপর সিবিআই। দফায় দফায় সারা রাজ্য জুড়ে তল্লাশি চালাচ্ছে সিবিআই । বর্তমানে কয়লা ও গরু পাচার নিয়ে সরগরম রাজ্য রাজনীতি। এ ভাবেই পাচার হচ্ছে কয়লা। বর্ধমান জেলার পাণ্ডবেশ্বর এলাকার বিভিন্ন খাদান থেকে সাইকেলে কয়লা চাপিয়ে ময়ূরাক্ষী নদী পেরিয়ে বীরভূমের ভীমগড় স্টেশনে নিয়ে আসা হয়। তার পর ট্রেনে যাত্রীবাহী ট্রেনে জেলার বিভিন্ন স্থানে পাচারের কয়লা নামানো হয় বলে অভিযোগ। নিত্য দিন এমন ঘটনা ঘটলেও পুলিশ-প্রশাসনকে কোনও পদক্ষেপ করতে দেখা যায় না বলেই স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি ।

বন্ধুনি : এখন বারাবনি ও সালানপুরে কয়লা চুরির রমরমা সবচেয়ে বেশি। এর পরে জামুড়িয়া, রানিগঞ্জ, কুলটি ও আসানসোলের কিছু এলাকায় চলছে এই চুরি। সালানপুরের বনজেমাহারি, সংগ্রামগড়, ডাবর কোলিয়ারি লাগোয়া এলাকায় খাদান গড়ে কয়লা তুলছে চোরেরা। বনজেমাহারি রেল সাইডিং থেকেও কয়লা চুরি যাচ্ছে। বারাবনির রসুনপুর এলাকা থেকেও চোরেরা কয়লা কাটছে। সাইকেল, গরুর গাড়ি বা মোটরবাইকে চাপিয়ে এই কয়লা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া অবৈধ ডিপোয়। রূপনারায়ণপুরের দেশবন্ধু পার্ক লাগোয়া এলাকার কিছু বাসিন্দার অভিযোগ, চোরেরা অবৈধ কয়লা পুড়িয়ে তা বস্তাবন্দি করে জ্বালানির কাজে ব্যবহারের জন্য বিক্রি করে। সেই কয়লা পোড়ানোর জেরে দূষণে তাঁরা নাজেহাল হচ্ছেন বলে ওই বাসিন্দাদের অভিযোগ। তাঁদের কথায়, “এই দূষণে শ্বাস নিতে পারি না। ঘরের দরজা-জানালা খোলা থাকলে হাঁফ ধরে যায়।” বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশকে অনেক বার বলেও কিছু হচ্ছে না।”

আমি : কয়লা পাচার-কাণ্ডে ধৃত ইস্টার্ন কোল্ডফিল্ড লিমিটেড এর সাত জন বর্তমান ও প্রাক্তন কর্তাকে পাঁচ দিনের সিবিআই হেফাজতে পাঠাল আদালত। বৃহস্পতিবার আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক রাজেশ চক্রবর্তী এই নির্দেশ দিয়েছেন। সিবিআই সূত্রের খবর, বর্তমান ও প্রাক্তন মিলিয়ে কোলের এই সাত ইসিএল আধিকারিককে বুধবার সকাল ১১টা নাগাদ নিজাম প্যালেসে ডেকে অনেক ক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তাঁদের জবাবে অসঙ্গতি ধরা পড়ায় গ্রেফতার করা হয়। ধৃতদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান ইসিএল আধিকারিক এসসি মৈত্র। পাশাপাশি, ইসিএলের তিন প্রাক্তন জেনারেল ম্যানেজার সুশান্ত ব্যানার্জি, অভিজিৎ মল্লিক এবং তন্ময় দাস। তন্ময় দাস আগে ইসিএলের প্রধান নিরাপত্তা আধিকারিক ছিলেন। এ ছাড়া ম্যানেজার নিরাপত্তা আধিকারিক ছিলেন মুকেশ কুমার। নিরাপত্তা আধিকারিক রিঙ্কু বেহেরা ও দেবাশিস মুখোপাধ্যায়।

বন্ধুনি : কয়লাগেট কেলেঙ্কারি কিন্তু কয়লা পাচার কেলেঙ্কারি থেকে আলাদা । কয়লাগেট কেলেঙ্কারিতে সরকারের ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছিল । কয়লা বরাদ্দ কেলেঙ্কারি বা ‘কয়লাগেট’ হল একটি রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি যা ২০১২ সালে ইউপিএ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সামনে আসে। কেলেঙ্কারিটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) প্রথম প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন।  তৎকালীন সরকারকে ২০০৪ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে অবৈধভাবে ১৯৪টি কয়লা ব্লক বরাদ্দ করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। যদিও CAG প্রাথমিকভাবে ১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ক্ষতির অনুমান করেছিল, চূড়ান্ত রিপোর্টে কেলেঙ্কারির পরিমাণ ১.৮৬ লক্ষ কোটি টাকা উল্লেখ করা হয়েছে।

আমি : গণধর্ষণ ? 

বন্ধুনি : ১৯৯০ সালের ৩০ মে গোসাবায় একটি টীকাকরণ কর্মসূচি সেরে তিন জন স্বাস্থ্য আধিকারিকের একটি দল কলকাতায় ফিরছিলেন।এই দলে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অতিরিক্ত জেলা গণমাধ্যম বিভাগের উপ-আধিকারিক অনিতা দেওয়ান, স্বাস্থ্য মন্ত্রকের উচ্চপদস্থ আধিকারিক উমা ঘোষ এবং ইউনিসেফের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন দিল্লি কার্যালয়ের প্রতিনিধি রেণু ঘোষ। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ যখন তারা ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের কাছে বানতলায় পৌঁছান তখন ৪-৫ জন যুবক স্থানীয় ক্লাবের কাছে তাদের গাড়ি থামাতে বাধ্য করে। গাড়ির চালক অবনী নাইয়া তাদের পাশ কাটিয়ে গাড়ি নিয়ে পালাতে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি উলটে যায়। এই সময় আরও ১০-১২ জনের একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়। তারা গাড়ির একজন আধিকারিককে টেনে বার করে। আগের দলটি অন্য দুই আধিকারিককে বার করে। গাড়ির চালক তাদের বাধা দিতে যান, কিন্তু ব্যর্থ হন। দলটি গাড়ির চালককে হত্যা করার চেষ্টা করে এবং গাড়িটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আধিকারিকদের কাছের একটি ধানক্ষেতে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণ করা হয়। একজন আধিকারিক তাদের বাধা দিতে যান। ধর্ষকরা তাকে হত্যা করে। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ পুলিশ গিয়ে আধিকারিকদের নগ্ন দেহ উদ্ধার করে। তাদের ক্যালকাটা ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজের আপদকালীন বিভাগে ভর্তি করা হয়ে। প্রথম দিকে তাদের মৃত মনে করা হয়ে হয়েছিল। কিন্তু দুজন বেঁচে ছিলেন। তাদের চিকিৎসা শুরু হয়। একজন মহিলা ডাক্তার জনৈক আধিকারিকের যোনিতে একটি ধাতব টর্চ দেখে অজ্ঞান হয়ে যান। আহত ড্রাইভার অবনী নাইয়াকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার দেহে ভারী অস্থের ৪৩টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।  আক্রমণকারীরা তার পুরুষাঙ্গটি পিষে দিয়েছিল। ১৯৯০ সালের ৪ জুন, সকাল ৫টা ৪০ মিনিটে তিনি মারা যান। 

আমি : হাঁসখালি গণধর্ষণের কাণ্ড শুনেছিলাম ?

বন্ধুনি : হাঁসখালি গণধর্ষণ কাণ্ডে ধীরে ধীরে নিজেদের তদন্তের জাল গুটিয়ে আনতে শুরু করে দিলো সিবিআই। হাইকোর্ট দ্বারা তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার পরই তাদের আসরে নামতে দেখা যায়। গতকাল হাঁসখালি কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত ব্রজ গোপালের বাবা তথা তৃণমূল নেতা সমরেন্দ্র গোয়ালিকে গ্রেফতার করা হয়। এদিন তাকে চার দিনের সিবিআই হেফাজতের রায় দিলে রানাঘাট মহকুমা আদালত। তবে এসকল বিষয়কেও ছাপিয়ে এদিন আদালতে তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে বিস্ফোরক দাবি করল সিবিআই। হাঁসখালি ধর্ষণ কাণ্ডে প্রথম থেকেই নিরুদ্দেশ ছিল মূল অভিযুক্ত ব্রজ গোপালের বাবা সমরেন্দ্র গোয়ালি। তবে শেষ পর্যন্ত সিবিআইয়ের জালে ধরা পড়ে সে। এরপর বেশ কয়েকবার সিবিআইয়ের তলবের মুখে পড়তে হয় তাকে এবং গতকাল তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। এলাকার শক্তিশালী নেতা হওয়ায় মৃত্যুর পরপরই ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া ওই কিশোরীর দেহ সৎকার করা হয়। এ ঘটনা যাতে প্রকাশ না পায়, সে জন্য ধর্ষণকারীর বাবা কিশোরীর পরিবারকে মামলা না করার হুমকি দেন। ফলে ঘটনার পর চার দিন কিশোরীর বাবা কোনো কথা না বললেও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা চাইল্ড লাইনের সহযোগিতায় হাঁসখালি থানায় ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করেন। ঘটনার পর পুলিশ প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তিসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করলেও গা ঢাকা দেন ধর্ষণকারীর বাবা সমরেন্দ্র গয়ালি ।

আমি : বর্ধমানের কালনায় গণধর্ষণের শিকার হলেন এক আদিবাসী গৃহবধূ। স্বামীর অনুপস্থিতিতে তাঁকে গভীর রাতে বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় দুষ্কৃতীরা। অভিযোগ, দুষ্কৃতীদলে ছিলেন এক মহিলাও। আক্রান্ত বধূকে হাসপাতালে ভর্তি করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। ইতিমধ্যে ১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে কালনা থানা সূত্রে। মঙ্গলবার গভীর রাতে ঘর থেকে কোনও কাজে বেরিয়েছিলেন মহিলা। আগে থেকেই বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছিল দুষ্কৃতীরা। মহিলা বেরোতেই তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। গলায় ছুরি ধরে মুখ বেঁঝে নিয়ে যায় নিরালা জায়গায়। সেখানে মহিলাকে একে একে ৩ জন ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, দুষ্কৃতীদের মধ্যে ছিলেন এক মহিলাও। তার সামনেই বধূকে ধর্ষণ করে দুষ্কৃতীরা। মহিলা জানিয়েছেন, বেশ কিছুক্ষণ নির্যাতনের শিকার হয়ে রাতের অন্ধকারে কোনও ক্রমে পালিয়ে বাঁচেন তিনি। তবে চোখ বাঁধা থাকায় দুষ্কৃতীদের কাউকেই দেখতে পাননি। মহিলা বাড়ি ফিরলে তাঁকে কালনা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে ভর্তি করেন পরিজনরা। খবর যায় থানায়। ঘটনায় গণধর্ষণের ধারায় অভিযোগ দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। 

বন্ধুনি : নতুন ক্যামেরা দেখানোর নাম করে এক নাবালিকাকে ফুঁসলে নিয়ে গিয়ে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠল গাইঘাটায়। ধর্ষণে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে এক নাবালকের বিরুদ্ধে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই নাবালিকা বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আর ফেরেনি। এরপরই সেই নাবালিকার খোঁজে বের হয় তার পরিবারের লোকেরা। সেই নাবালিকার বাবা দাবি করেছেন, যে ঘরে এই ঘটনাটি ঘটেছিল সেখানে খুব জোরে গান চালানো ছিল মিউজিক সিস্টেমে। যাতে চিৎকারের আওয়াজ বাইরে না আসে। 

আমি : বাঞ্চোৎ বাঙালি ছোঁড়াগুলো কাউকেই ছাড়ে না !

বন্ধুনি : ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি আদিবাসী অধ্যুষিত বীরভুম জেলার লাভপুর থানা এলাকার মধ্যে সুবলপুর গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। এর আগে, ২০শে জানুয়ারি সালিশি সভার “তলবে” অত্যাচারিতা এবং তার প্রেমিককে ধরা হয় এবং সারা দিনরাত আটকে রাখা হয়, তাদের একটি গাছে বেঁধে লাঞ্ছিত করা হয় বলে অভিযোগ। এরপর ক্যাঙ্গারু আদালত তাদের ৫০,০০০ টাকা জরিমানা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। মেয়েটি যখন জরিমানা দিতে অক্ষম হয়, তখন গণধর্ষনের আদেশ দেওয়া হয়।নির্বাচিত গ্রাম পঞ্চায়েত নেতার নেতৃত্বে গ্রাম স্তরের স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠান গ্রাম সভা সালিশি সভা নামে একটি ক্যাঙ্গারু আদালতের আয়োজন করেছিল । সালিশি সভার প্রধান সুনীল সোরেনও এই ধর্ষণের সাথে জড়িত ছিল। 

আমি : এবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার নামখানায় এক মহিলাকে গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে । প্রমাণ লোপাটে ওই মহিলার গায়ে কেরোসিন ঢেলে তাঁকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে অভিযুক্তরা ৷ হাঁসখালিতে নাবালিকাকে ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনার মধ্যেই নামখানার এই ঘটনা রাজ্যে মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে ৷ নির্যাতিতা ওই মহিলা বর্তমানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপ মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন । ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে নামখানা থানার পুলিশ

বন্ধুনি : অভিযুক্তরা কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখানোয় বাংলাদেশের শরিয়তপুর জেলার পুটিয়াকান্দির ১৭ বছরের এক কিশোরী ভারতে নিয়ে আসে। পরিবারের আর্থিক টানাপড়েন দূর করতে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা বাগদার হরিহরপুরে আসে সে। শরিফুল মল্লিক নামে এক যুবকে তাকে কাজ জোগাড় করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ওই কিশোরী।বাগদা পুলিশ বলছে, শরিফুল মল্লিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে অবৈধপথে ভারতে আসে ওই কিশোরী। সেখানে যাওয়ার পর ১৪ অক্টোবর  শরিফুল মল্লিক ও তার সঙ্গী মহসিন বিশ্বাস কিশোরীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন। গ্রামের বাসিন্দারা কিশোরীকে ধর্ষণের এই খবর থানায় পৌঁছে দেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তাকে উদ্ধারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তার অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের এবং দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

আমি : মেয়ে পাচার ?

বন্ধুনি : জানা যায়, এই নিয়ে ১৫ বার বিয়ে করতে যাচ্ছিল অভিযুক্ত। এসিপি ইস্ট শুভেন্দ্র কুমার জানান , “রাহুল সরকার ওরফে রাজু ওরফে সফিয়ুল ইসলামের নামে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক থানায় অভিযোগ রয়েছে। মূলত ধর্ষণ ও অপহরণের অভিযোগ রয়েছে। শিলিগুড়ি থানা, ভক্তিনগর থানা, মেটেলি ও হলদিবাড়ি থানাতেও অভিযোগ রয়েছে। মূলত প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে মেয়েদের পাচার করত সে। জিজ্ঞাসাবাদ করে আরও তিনজন মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে। গোটা ঘটনার তদন্ত চলছে। পুলিশের অনুমান এই ঘটনার পেছনে বড় কোনও পাচার চক্র জড়িত। 

আমি : কন্যা ভ্রূণ বা কন্যাশিশু হত্যার কারণে পাঁচ কোটি মেয়ে ভারত থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। সমস্যাটা সবচেয়ে প্রকট উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোতে, যেখানে বহু পুরুষ বিয়ে করার মতো মহিলাই পাচ্ছেন না – আর তার জেরে সারা দেশ জুড়ে জন্ম হচ্ছে সংগঠিত নারী-পাচার চক্রের। দারিদ্র্য ও অসচেতনতার সুযোগে বিয়ে করেন ৭৫টি, বিয়েকে হাতিয়ার করে পাচার করেন ২০০জন নারীকে৷ কেউ আবার পাচার করেন কিশোরীর টিকটক তারকা হবার স্বপ্নকে ভাঙিয়ে৷ উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্য‌ এবং গোটা ভারতের মধ্য‌ে সংযোগের কাজ করে থাকে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্য‌ের ১৯টি জেলা রয়েছে এবং ২৩টি শহর রয়েছে যার জনসংখ্য‌া এক লক্ষেরও বেশি। সব চেয়ে বড় শহরগুলি হল, কলকাতা, আসানসোল, শিলিগুড়ি ও হাওড়া — এই শহরগুলি পাচার হয়ে যাওয়ার বড় কেন্দ্র। এই শহরগুলিতে বেশ কয়েকটি পরিচিত ‘লালবাতি’ এলাকা রয়েছে যেখানে দেহ ব্য‌বসার কথা সুবিদিত। অন্য‌ দিকে রাজ্য‌ের গ্রামের বিস্তৃত অঞ্চলে দারিদ্র, শোষণ ও বঞ্চনা এখনও রয়ে গিয়েছে। সেখানে লিঙ্গ বৈষম্য‌ রয়েছে, রয়েছে গার্হস্থ্য হিংসার বাতাবরণও। এই দারিদ্রপীড়িত সামাজিক ক্ষেত্র, যেখানে জীবনধারনের জন্য‌ স্থায়ী রোজগারের ব্য‌বস্থা নেই, তা পাচারকারীদের শিকার ধরার আদর্শ জায়গা। এই রাজ্য‌ের সঙ্গে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের আন্তজার্তিক সীমানা রয়েছে। এই গুরুত্বপূর্ণ ও ভঙ্গুর অবস্থানের জন্য‌ এ রাজ্য‌ শুধু আন্তর্রাজ্য‌ পাচার নয় বরং আন্তর্জাতিক পাচারের উল্লেখযোগ্য‌ কেন্দ্র হিসাবে চিহ্নিত। এক দিনে এই পরিস্থিতি গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন ধরে পাচারকারীরা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে অঞ্চল চিহ্নিত করে তাদের কাজ চালিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তাদের পাল্টা নেটওয়ার্কের মোকাবিলা করা খুবই দুষ্কর।

বন্ধুনি : চোলাই ?

আমি : চোলাই মদ মূলত ইথাইল অ্যালকোহল। আবগারি দফতর ও চোলাইয়ের কারখানাগুলির থেকেই জানা গিয়েছে, মদের আকর্ষণ বাড়াতে ইথাইল অ্যালকোহলের সঙ্গে পিরিডিন জাতীয় জৈব খার, মিথানল, ইউরিয়া এমনকী কীটনাশক বিষও মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে আজকাল। তাতে চোলাই খাওয়ার পর অল্প সময়েই নেশায় বুঁদ হয়ে যাওয়া যাচ্ছে। নেশার বহর বা়ড়তেই বেড়ে চলেছে খদ্দেরও সংখ্যাও। কিন্তু দিনের পর দিন বিষাক্ত এই মদের জেরে শরীরে থাবা বসাচ্ছে নানা মারণ রোগ। নষ্ট হচ্ছে চোখ। এমনকী অনেক সময়ই নেমে আসছে মৃত্যু। চোলাইয়ের শিকার যাঁরা, তাঁরা অনেকেই এ সব জানেন। তবু ছাড়তে পারেন না। অনেকে আবার এ সব জানেনও না। দিনের পর দিন নেশার বিষ শরীরে ঢুকে চলেছে সামান্য সুখানুভবের হাত ধরে।গৃহস্থ বাড়ির মাটির উনুনে বড় হাঁড়িতেই চোলাই তৈরি হয়। গ্রামে নানা পদ্ধতিতে তৈরি হয় চোলাই। আগে নিম্নমানের চাল দিয়ে ভাত তৈরি করে নেওয়া হয়। তারপর তাতে বাখড় মিশিয়ে দেওয়া হয়। বাখড় হল এক ধরনের মিষ্টি যা মূলত চোলাইয়ে ইস্ট-এর কাজ করে। অর্থাৎ চটজলদি ভাত পচাতে সাহায্য করে। ভাত পচে গেলে একটি বড় হাঁড়িতে বসিয়ে তা ফের ফোটানো হয় উনুনে। ওই হাঁড়ির উপরে বসানো হয় আরও একটি হাঁড়ি। পচা ভাতের বাষ্প পাইপের মাধ্যমে ফোঁটা ফোঁটা করে জমা হয় জারিকেনে বা বোতলে। এটাই হচ্ছে চোলাই মদ বা ইথাইল অ্যালকোহল। কেউ কেউ আবার পচা ভাতের বদলে চিটে গুড় বা চিনির গাদার সঙ্গে বাখড় মিশিয়ে তৈরি করেন চোলাই। এখন নেশার বহর বাড়িয়ে এই মদের খদ্দের বাড়াতে এর সঙ্গে মেশানো হচ্ছে নানা রকমের রাসয়নিক দ্রব্য। ইউরিয়া, পিরিডিন থেকে মিথানল মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বন্ধুনি : ধৃতদের কাছ থেকে বিভিন্ন বিলিতি ব্র্যান্ড মদের স্টিকার লাগানো বোতল ও ৩২ লিটার নকল মদ উদ্ধার করেছে আবগারি দফতর। এ ছাড়া, মিলেছে মদ তৈরির উপকরণও। জেলা আবগারি দফতরের সুপারিন্টেন্ডেন্ট শম্ভু রায় বলেন, “ধৃতেরা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিলিতি মদের বোতল জোগাড় করে তাতে নতুন করে ওই কোম্পানির স্টিকার লাগিয়ে নকল মদ ভরে বিক্রি করত। এই মদ খেলে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই চক্রের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত কিনা, তা দেখা হচ্ছে। আবগারি দফতরের দাবি, জেরায় ধৃতেরা জানিয়েছেন, রাহুল ও তাঁর বাবা নিজের বাড়িতে ওই নকল মদ বানাতেন। বিলিতি মদের খালি বোতল জোগাড় করতেন। বিভিন্ন মদের ব্র্যান্ডের নকল স্টিকার ও হলোগ্রামও মজুত ছিল তাঁদের কাছে। নকল মদ বানিয়ে পুরনো বোতলে নতুন করে ভরে নকল স্টিকার ও হলোগ্রাম বোতলে লাগিয়ে দেওয়া হত। লক্ষ্মণ তাঁদের বানানো মদ বিভিন্ন ধাবা ও দোকানে বিক্রি করতেন। বাঁকুড়ার ধলডাঙায় গোপাল বাঙালের একটি ধাবা রয়েছে। ওই ধাবাতেও এই নকল মদ বিক্রি হত। আবগারি দফতরের এক কর্তা জানান, এই কারবারের খবর গোপন সূত্রে পেয়ে প্রথমে লক্ষ্মণকে আটক করে জেরা করতেই তিনি সব ফাঁস করে দেন। বৃহস্পতিবার রাতে ধরপাকড়ে নামে আবগারি দফতর। প্রথমে রাহুলের বাড়িতে অভিযান চলে। সেখানে নকল মদ, মদ তৈরিতে ব্যবহৃত প্রায় ৩০ লিটার স্পিরিট, দুই লিটার ক্যারামেল-সহ বিভিন্ন উপকরণ উদ্ধার হয়। পাশাপাশি প্রায় ৬ হাজার বিভিন্ন বিলিতি মদের ব্র্যান্ডের স্টিকার ও নকল হলোগ্রাম এবং বহু পুরনো মদের খালি বোতল পান আবগারি দফতরের আধিকারিকেরা। উদ্ধার হয়েছে বেশ কয়েক বোতল দিশি মদও। 

আমি : পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে অধ্যাপকের বেশে রাজনৈতিক দালালরা ছাত্রভর্তিতে তোলাবাজি,পরীক্ষায় পাশ করানোর নামে অনৈতিক সুবিধা নেওয়া,ছাত্রীদের হেনস্থা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে রয়েছে বামপন্থী-তৃণমূলী বুদ্ধিজীবীরা। শিলিগুড়ি কলেজের অধ্যাপক অমিতাভ কাঞ্জিলাল ছাত্রীকে পরীক্ষায় পাশ করাতে দশ হাজার টাকা চাইছেন,বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অংশুমান কর একাধিক ছাত্রীকে হেনস্থা করছেন, আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কনফিডেন্সিয়াল একাউন্ট এর টাকা নয়ছয়ের পরেও দিলীপ সরকারের মতো ব্যক্তি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার পদে পুনর্বহাল হচ্ছেন।

বন্ধুনি : ভিন রাজ্য থেকে বিভিন্ন পন্য বাংলাদেশে আমদানি- রপ্তানি হয় বসিরহাটের ঘোজাডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে। ইট, বালি, পাথর, ফল, ফুল, সবজি, তেল বিভিন্ন কাঁচামাল যায় বাংলাদেশে। বাংলাদেশ থেকেও এদেশের বিভিন্ন রাজ্যে যায় বিভিন্ন পন্য। এই যাতায়াতের পথে বিভিন্ন ট্যাক্স দিয়ে থাকেন পণ্যবাহী ট্রাক চালকরা। টোল ট্যাক্স বা পৌরকরের মতো বিভিন্ন ট্যাক্স দিয়ে যাতায়াত করতে হয় ট্রাক গুলোকে। কিন্তু ট্রাক চালক ও খালাসিদের অভিযোগ, ‘বিভিন্ন নিয়মী কর ছাড়াও নতুন করে কর ধার্য করা হয়েছে এই আমদানি রপ্তানির ট্রাকগুলোর উপর। সেখানে বসিরহাট ব্রিজ থেকে ঘোজাডাঙ্গা বর্ডার অব্দি যেতে একটা অংকের টাকা দিতে হয় ট্রাক গুলিকে। তার কোনোটিতে লেখা ‘শ্রমিক ইউনিয়ন’, কোনোটিতে ‘কর্মহীন শ্রমিক বাঁচাও কমিটি’ কোনোটি ‘বর্ডার গাইড’। এই রকম বিভিন্ন নামে বিল ছাপিয়ে ট্রাক গুলির উপর থেকে কর আদায় করে বেশ কয়েকটি ছেলে। মূলত বসিরহাট থেকে ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে কল বাড়ি, কালীবাড়ি মোড় এইসব অঞ্চলগুলোতে বাঁশ ফেলে ট্রাক আটকানো হয়। এরপর ট্রাকচালকদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি বিল। যদি টাকা না দেওয়া হয় তাহলে ট্রাক যেতে দেওয়া হয় না। ট্রাক চালকদের গাড়ি থেকে নামিয়ে মারধর করা হয় বলে জানান ট্রাক চালক সুরিন্দর সিং। তবে স্থানীয় ট্রাক গুলোর ক্ষেত্রে মাসোহারার ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের জন্য একটি পরিচয় পত্রের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে সিন্ডিকেট। সারা বাংলা ট্রাক মালিকদের সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক সজল ঘোষ জানান, ‘এই সবটাই হয় স্থানীয় প্রশাসনের সমর্থনে। পুলিশই জুলুম করে টাকা নেয়। এটা সীমান্তে আসা ট্রাক গুলোর দীর্ঘদিনের অভিযোগ। ট্রাক ড্রাইভাররা বহুবার আক্রান্ত হয়েছে। আমরা একাধিক অভিযোগ করে ফল পায়নি। তাই আজ ধর্মঘটের পথে।’ সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, বিভিন্ন পণ্যের ট্রাক পিছু ভিন্ন ভিন্ন মূল্য ধার্য করা রয়েছে। খালি ট্রাক গেলে ২০০ টাকা, পাথর বোঝাই গাড়ি ১৩০০ টাকা, আলু, পটল, পেঁয়াজের মতো আনাজ বা সবজির গাড়ি পিছু ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। আরও জানা গিয়েছে, প্রত্যেকদিন ৩০০ থেকে সাড়ে ৩৫০টির বেশি পণ্যবাহী গাড়ি এখান দিয়ে যাতায়াত করে। তাহলে যদি প্রত্যেক গাড়ি থেকে গড়ে ৮০০ থেকে ১০০০ বা ১৫০০ করে টাকা নেওয়া হয় তাহলে দিনে কয়েক লক্ষ টাকা উঠছে। মাসে কোটি কোটি টাকা আদায় করছে সিন্ডিকেট। তবে সিন্ডিকেটের দাবি, ‘এই টাকার একটা অংশ ভোগ করছে সিন্ডিকেট। অন্য অংশ যায় পার্টির ফাণ্ডে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক নেতা জানান, ‘বছর খনেক আগে থেকে গরু পাচার বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই এই নতুন ব্যবসা চালু হয়। এর নেপথ্যে রয়েছে বসিরহাটেরই এক শীর্ষ নেতা। যার অঙ্গুলি হেলনেই হয় সমস্ত কিছু। দীর্ঘদিন ধরে বসিরহাটে গরু পাচারের হোতা ছিলেন তিনি। গরু বন্ধ হতেই এই ব্যবসা শুরু করেন তিনি। সাম্প্রতিক এক বস্তা সোনার বার সমেত ধরাও পড়েছিলেন তিনি। সোনা ছাড়াও প্রশাসনের নাকের ডগায় ভিন্ন বেআইনি কারবার চালিয়ে আসছেন তিনি।’ তবে এনিয়ে প্রশাসনের কাছে কোনও অভিযোগই নেই বলে জানান বসিরহাট পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার কে শবরী রাজকুমার। তবে তদন্ত করে ঘটনাটি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। এনিয়ে রা বসিরহাটের বিজেপি প্রার্থী সায়ন্তন বসু এই ঘটনাকে তোলাবাজির লেটেস্ট নিদর্শন বলে আক্ষা দিয়েছেন। তার কথায়, ‘এর আগেও সিপিএম তোলাবাজি করত তবে সেটা আন-রেজিস্টার ছিল। এখন এটা স্বীকৃত তোলাবাজি আর সিন্ডিকেট রাজে পরিণত হয়েছে।’ 

আমি : পার্কস্ট্রিট গণধর্ষণ কাণ্ড ?

বন্ধুনি : ২০১২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। পুলিশ প্রথমে মহিলার অভিযোগ নিতে অস্বীকার করে । সংবাদমাধ্যমের চাপে শেষপর্যন্ত অভিযোগ দায়ের করে পার্কস্ট্রিট থানা। সরকারের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয় মহিলা সঠিক অভিযোগ করছেন না। এরপর তৎকালীন পুলিস কমিশনারও মহিলার বক্তব্যে অসঙ্গতি রয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন। তৎকালীন পুলিসকমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা সাংবাদিকদের বলেন, `নাথিং হ্যাপেনড`। তদন্তের আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ঘটনাটিকে সাজানো বলে মন্তব্য করেছিলেন।পরে অবশ্য গোয়েন্দারা ধর্ষণের প্রমাণ পান, কিন্তু তারপরেই সরিয়ে দেওয়া হয় পুলিশের গোয়েন্দা প্রধানকে।আদালতে ধৃতদের যে চার্জ পড়ে শোনানো হয়, তাতে তিন অভিযুক্ত – সুমিত বাজাজ, রুমন খান ও নাসির খান – সবার বিরুদ্ধেই গণধর্ষণ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে। দুজনের বিরুদ্ধে মারধর ও হুমকির অভিযোগও রয়েছে ।মূল অভিযুক্ত কাদের খান এবং আরও একজন এখনও ফেরার রয়েছে।

আমি : পার্ক স্ট্রিটের একটি পাঁচতারা হোটেলের নাইটক্লাব থেকে ওই মহিলাকে নিয়ে গাড়িতে করে বেরিয়েছিলেন অভিযুক্তরা তার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ছবি, তাদের গাড়ি থেকে পাওয়া ধর্ষণের প্রমাণ, ডিএনএ পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়েছে পুলিশ । অন্যান্য শহরে চলন্ত গাড়িতে গণধর্ষণের কথা শোনা গেলেও কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে রাজপথে দীর্ঘক্ষণ ধরে একটি গাড়িতে গণধর্ষন করা হচ্ছে, পুলিশের নজরে পড়ছে না, আবার ভোররাতে একটা থানার কাছেই গাড়ি থেকে ধর্ষিতাকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে– এটা একটা বিরল ঘটনা । তদন্ত শুরুর আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলে দেন যে সরকারের বেকায়দায় ফেলার জন্য ঘটনাটা সাজানো হয়েছে । পুলিশ কমিশনারকে দিয়েও প্রায় একই বয়ান দেওয়ানো হয়। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে যখন ব্যাপক সমালোচনা চলছে, তখনই পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ প্রাথমিক তদন্তে গণধর্ষনের প্রমাণ পাওয়ার কথা ঘোষণা করে দেয়। মুখ্যমন্ত্রী যেটাকে সাজানো ঘটনা বলেছিলেন, সেটাকে গণধর্ষণ বলে দেওয়াতে কয়েকদিনের মধ্যেই কম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে বদলি করা হয় কলকাতার প্রথম মহিলা গোয়েন্দা প্রধান দময়ন্তী সেনকে। মুখ্যমন্ত্রীর ‘সাজানো ঘটনা’ মন্তব্যের পরে কয়েকজন রাজ্যের এক মন্ত্রী ওই মহিলা যৌনকর্মী কী না – সেই ইঙ্গিতবাহী প্রশ্ন করেছিলেন। কংগ্রেসের এক মহিলা সাংসদ আবার সেই ইঙ্গিত দিয়ে বলেন যে পার্ক স্ট্রিটের ঘটনা কোনও ধর্ষণ নয়, ওই মহিলা আর তাঁর ক্লায়েন্টদের মধ্যে দরদাম নিয়ে অশান্তি করেছিলেন ।  এই মামলায় সরকারের দায়সারা মনোভাবের জন্য সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ।

বন্ধুনি : সাড়ে চার বছরের বেশি পালিয়ে পালিয়ে থেকেও লাভ হল না। শেষ পর্যন্ত পুলিসের জালে ধরা পরে গেল পার্কস্ট্রিট গণধর্ষণ কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত কাদের খান ও তাঁর সঙ্গী আলি। কিন্তু কীভাবে পুলিস দুজনের খোঁজ পেল? গতমাসে পুলিস জানতে পারে বিহার-নেপাল সীমান্তের গ্রামে রয়েছে । কাদেরের পরিবারের সদস্যদের উপর নজর রাখতে শুরু করে পুলিস। তাঁদের ফোন ট্র্যাক করে পুলিস।  দেখা যায় দিল্লির একাধিক নম্বর থেকে ফোন আসছে কাদেরের বাড়িতে।বিভিন্ন মাধ্যমে দিল্লিতে টাকাও পাঠাচ্ছেন কাদেরের পরিবারের সদস্যরা। পুলিস নিশ্চিত হয় দিল্লি বা সংলগ্ন এলাকাতেই লুকিয়ে আছে কাদের আর আলি। একাধিক ফোন নম্বর ব্যবহার বাড়িতে যোগাযোগ করছে। এরপরেই গাজিয়াবাদে কাদের আর আলির ডেরার খোঁজ মেলে। সেখান থেকেই দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিস।

আমি : মানে কী ধরণের অসৎ মানুষ নেই যারা পশ্চিমবঙ্গকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে ; একেবারে ওপর থেকে নিচেতলা পর্যন্ত । পশ্চিমবঙ্গে তথাকথিত পরিবর্তনের সরকারের এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দুর্নীতির কেলেঙ্কারির খবরে সাধারণ মানুষ দিশেহারা ; আবার এই সাধারণ মানুষদের কারণেই ঘটেছে ঘটছে ঘটেছিল নানা রকম কেলেঙ্কারি। বছরের পর বছর ধরে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাদের রাজনীতিবিদদের বালি, কয়লা আর গরু চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে প্রথম দিকে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। বিভিন্ন উপায়ে চাঁদা তোলাকেও স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে—এটা নিয়ে  কেউ বিশেষ কথা বলে না । “কাট-মানি” – নামের  ঘুষ,  এই অনন্য শব্দ  এখন বাংলা অভিধানে ঢুকে পড়েছে। 

.

বন্ধুনি :  ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) আশানুরূপ কাজ না করার পরে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে তার দলের সদস্যদের নাগরিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা কাট-মানি ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুল শিক্ষায় দুর্নীতি কাট-মানির পাহাড় ডিঙিয়ে দূর্নীতির অন্য পারে চলে গেছে।আমরা এটাও মেনে নিই যে আমাদের অনেক রাজনীতিবিদই দুর্নীতিগ্রস্ত। আমরা উত্তেজিত হই – বা মেজাজ খারাপ করি কিন্তু আমাদের মতন নিম্ন-মধ্যবিত্তের  মানদন্ড প্রয়োগ করেও পশ্চিমবঙ্গের হাল আমলের  দুর্নীতি পিলে চমকে দেবার মতন। আর সাধারণ বাঙালি এখন ক্ষুব্ধ-ক্রুদ্ধ-বিরক্ত কারণ ব্যাপারটা ঘটেছে-ঘটছে-ঘটেছিল শিক্ষার ক্ষত্রে ।

.

আমি : এটা এখন কমবেশি প্রমাণিত যে, সরকার গত ১০ বছরে সরকারি স্কুলে হাজার হাজার শিক্ষক নিয়োগ করেছে মেধার ভিত্তিতে নয়, নগদ টাকা নিয়ে, আর আমরা টিভিতে দেখেছি একজনের টাকার গোলাপি-সবুজ পাহাড়। আবেদনকারীরা পোস্টগুলোর জন্য যে বাধ্যতামূলক পরীক্ষা দিয়েছিল তার প্রকৃত ফলাফল গোলমাল করে দেয়া হয়েছিল ।  এমনকি যারা ফাঁকা উত্তরপত্র জমা দিয়েছিল তাদেরও চাকরি দেওয়া হয়েছিল –৫ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ ক্যাশ টাকা নিয়ে, কতো টাকা দিতে হবে-হয়েছে তা  প্রাথমিক ,মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে বিদ্যালয়ের চাকরির  উপর নির্ভর করে।

বন্ধুনি : হাটে হাঁড়ি ভাঙার জন্য বেশিরভাগ কৃতিত্ব কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের, যিনি উদ্যোগ এবং সাহসের সাথে ব্যাপারটা অনুসরণ করেছিলেন এবং সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকে ডেকেছিলেন। পচা আশ্চর্যজনকভাবে গভীর এবং আশ্চর্যজনকভাবে উঁচুতে যায়। রাজ্য স্কুল বোর্ডের শীর্ষ সদস্যদের অনেকেই এখন কারাগারে, বিচারের অপেক্ষায়। এছাড়াও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী; কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি তার “ঘনিষ্ঠ বন্ধু” অভিনেত্রীর বাড়ি থেকে 50 কোটি টাকারও বেশি নগদ এবং গয়না জব্দ করেছে।

আমি : পঞ্চাশ কোটি টাকা আসলে জিনিসের মাপকাঠিতে খুব সামান্য পরিমাণ। অল্প সময়ের টিএমসি রাজনীতিবিদদের যাদের কথা তাদের আশেপাশের বাইরের কেউ শুনেনি তারা সরাসরি শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারির সাথে তিরিশ-চল্লিশ কোটি টাকা অবৈধ অর্থ সংগ্রহের জন্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। দল ও সরকারের সিনিয়র ব্যক্তিরা কতটা বড় হয়ে উঠতে পারে, তা কেউই ভাবতে পারবেন না। কলকাতা হাইকোর্ট ইতিমধ্যেই হাজার হাজার স্কুলশিক্ষকের নিয়োগকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেছে এবং এমনকি এই নিয়োগকারীদের এখন পর্যন্ত তাদের অর্জিত বেতন ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

বন্ধুনি : এখানে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে এবং প্যান্ডোরার বাক্সটি সম্ভবত মাত্র একটু খোলা হয়েছে। বেশ কয়েকটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে এবং দেখাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মৌলিক পাটিগণিত করতে পারে না। তারা বলতে পারে না, ব্ল্যাকবোর্ডে ১১-র সঙ্গে ২৬ যোগ করলে কতো হয় । এই মূর্খরা যাদের শিক্ষা দিচ্ছে তাদের ভাগ্য কি হবে?

আমি : পড়েছি কাগজে ।

বন্ধুনি :  এই লোকেরা কি  শিক্ষকতাও করে, অর্থাৎ যে কাজগুলির জন্য তারা মোটা  বেতন পায় ?  স্কুল শিক্ষকের একটা সুরক্ষিত সরকারী বেতন রয়েছে। অথচ দেখা যাচ্ছে তিনি যখন খুশি কাজ করতে যেতে পারেন এবং পাশাপাশি একটি ব্যবসা বা চাঁদাবাজির র‌্যাকেট চালাতে পারেন। এটি এখন জানা গেছে যে বর্তমানে কারাগারে থাকা টিএমসি নেতার মেয়ে একজন স্কুলশিক্ষক ছিলেন, কখনও কাজে যাননি, এবং তাঁর উপস্থিতি রেজিস্টার বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হতো।

আমি : পড়েছি কাগজে ।

বন্ধুনি : প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর কোনো না কোনো ধরনের প্রত্যাশা থাকে যে সে তার বিনিয়োগ থেকে লাভ করবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য যদি হাজার হাজার মানুষ তাদের বাবা-মায়েরা তাদের সঞ্চয়ের সব কিছু বাজি ধরে থাকে, তাহলে এটা স্পষ্ট যে তারা বিশ্বাস করে এটা একটি সার্থক বিনিয়োগ। যেমন ধরুন, পুরুষ স্কুল শিক্ষক অনেক বেশি যৌতুক চাইতে পারেন। তিনি আনন্দের সাথে একটি পিরামিড স্কিমের অংশ হয়ে উঠবেন যেখানে তিনি অন্য লোকেদের কাজের জন্য সুপারিশ করেন এবং কাট-মানি নেন। প্রকৃতপক্ষে, ঘুষের জন্য একটি চমৎকার তহবিল নেটওয়ার্কও আছে বলে মনে হচ্ছে। আপনি ঘুষ প্রদানের জন্য একটি উচ্চ-সুদে ঋণ পেতে পারেন, চাকরি পেতে পারেন এবং তারপরে তা পরিশোধ করতে আপনার রাজস্ব স্ট্রীম তৈরি করতে পারেন। এই সমস্তই চরম চূড়ান্ততার একটি স্ব-চিরস্থায়ী প্রক্রিয়াকে ট্রিগার করে যার কোন শেষ থাকতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী যে কেউ তাদের সন্তানদের প্রাইভেট স্কুলে পাঠানোর উপায় নেই, তাদের ভবিষ্যত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

আমি : তার চেয়েও বড় কথা, এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে দুর্নীতি শুধু স্কুল শিক্ষার জায়গাতেই সীমাবদ্ধ । কয়েকদিন আগে, রাজ্যের ষাটটি পৌরসভার দ্বারা অন্তত ৫০০০ লোককে অবৈধভাবে নিয়োগ করার অভিযোগে একজন  টিএমসি রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এটা খুবই সম্ভব যে প্রতিটি বিভাগে সরকারি চাকরি বিক্রি হয় । একজন লোক যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা দিতে ইচ্ছুক হন, তাহলে একজন পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের জন্য আপনি কত টাকা দিতে পারেন? একজন কনস্টেবলের চাকরির জন্য বিনিয়োগের সম্ভাব্য রিটার্ন একজন স্কুল শিক্ষকের চেয়ে অনেক বেশি। একজনকে যা করতে হবে তা হল এলোমেলো নিরপরাধদের হয়রানি করা, তাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া এবং ক্ষমতায় থাকা দলের সদস্য ও সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত প্রকৃত অপরাধের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে ক্রিমিনালদের বাঁচানো।

বন্ধুনি : এমন একটি সমাজের কথা ভাবুন যেখানে আপনি আপনার সন্তানদের যে স্কুলে পাঠান, সেই স্কুলের শিক্ষকরা, আপনি অসুস্থ হলে যেসব সরকারি হাসপাতালে যান, সেই নার্সরা, যে পুলিশ আপনাকে রক্ষা করার কথা, ফায়ার ব্রিগেডের লোকেরা যাদেরকে আপনি যা কিছু বাঁচাতে ডাকেন তারা, আপনার আমার আত্মীয় । অথচ সবাই ঘুষের মাধ্যমে  চাকরি পেয়েছে আর এমন একটা সিস্টেমের প্রচার করছে যাতে  যোগ্যতার  কোনও গুরুত্ব নেই। পশ্চিমবঙ্গ হয়তো ডিস্টোপিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে।

আমি : মানস দাসের ‘বাংলাদেশ ওয়র’ পড়েছিস ? উনি লিখেছেন যে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মুর্শিদাবাদের জোতদার আর পয়সাঅলারা তাদের ছাদে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়েছিল ।

বন্ধুনি : হ্যাঁ, অনেকে ইন্দিরা গান্ধীর শাপশাপান্ত করেছিল জানি । ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রীসভার ফখরুদ্দিন আলি আহমদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল । তাছাড়া মইনুল হক চৌধুরী, আবদুস সাত্তার, জয়নাল আবেদিন, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, গোলাম ইয়েজদানি ওরা খোলাখুলিভাবে বিরোধিতা করেছিল । মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের বিরোধিতা করেছিল ।

আমি : আসলে অনেকের আত্মীয়স্বজন পাকিস্তানের উঁচু পদে চাকরি করতো, এখনও করে ।

বন্ধুনি : এও তো একধরণের দূর্নীতি । মানে, নৈতিক দায়-দায়িত্ববোধ ছিল না লোকগুলোর । কেন জানেন ? সাধারণ অর্থে যে কোন ‘নীতি-বিগর্হিত কর্ম’কেই দুর্নীতি বলা হয়। এক্ষেত্রে ‘নীতি’ শব্দের অর্থ নিছক ‘Policy’ নয়। নীতি হল ‘ethics’, অর্থাৎ এমন এক ‘সদর্থক মূল্যবোধ’, একমাত্র বিবেকের কাছেই যা দায়বদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে এই ‘বিবেকনির্ভর মূল্যবোধ’ সমাজকে ধারণ করছে আর সেই কারণেই একে ‘ধর্ম’ বলা চলে। আর এখানেই ‘অপরাধ’ মানে Crime ও ‘দুর্নীতি’র মানে Corruption-এর  মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রভেদ চোখে পড়ে। অপরাধ আইনের শাসনকে লঙ্ঘন করে আর আইনের সাহায্য নিয়েই আদালত অপরাধীকে দণ্ড দেয়। কিন্তু দুর্নীতি সরাসরি আইনের বিরোধীতা করে না। সেটি ব্যাধির মত নিঃশব্দে আইনের নজর এড়িয়ে সমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আর সমাজের নৈতিক অধঃপতন ঘটায়। এই প্রক্রিয়া এত মন্থর গতিতে অগ্রসর হয় যে অনেকসময় বাইরে থেকে সেটাকে অনুভব করা যায় না।

আমি : কালো টাকা ? 

বন্ধুনি : ভারতে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থকে কালো টাকা বলা হয় কালো টাকাও এমন যেটির ওপর কর আরোপ করা হয়নি । বিদেশী ব্যাঙ্কগুলিতে ভারতীয়দের দ্বারা গোপনে জমা করা অর্থের কোনও নির্দিষ্ট জ্ঞান নেই , তবে মিঃ আর. বৈদ্যনাথন অনুমান করেছেন যে এর পরিমাণ প্রায়  ৭,২৮০,০০০ কোটি টাকা।

আমি : দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য লোকপাল-লোকায়ুক্ত  হয়েছিল । তাদের সম্পর্কে তো কিছু শুনি না ।

বন্ধুনি : ২০১৩ সালের লোকপাল ও লোকায়ুক্ত আইনে রাষ্ট্রপতির সম্মতিদানের পাঁচ বছর পর একজনের নাম চূড়ান্ত হল। ব্যাপারটা এখনও ঝুলে আছে । একবার দেখে নেওয়া যাক বাকি লোকপালদের কীভাবে বাছাই করা হবে এবং তাঁরা কীভাবে কাজ করবেন । সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ”দেখা যাচ্ছে, জম্মু-কাশ্মীর, মণিপুর, মোঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, পুডুচ্চেরি, তামিল নাড়ু, তেলেঙ্গানা, ত্রিপুরা, পশ্চিম বঙ্গ এবং অরুণাচল প্রদেশ লোকায়ুক্ত/ উপ লোকায়ুক্ত নিয়োগ করেনি।

আমি : দুর্নীতির খবর ছাপার ফলে সাংবাদিকরা আক্রান্ত হচ্ছে । খুনও হয়েছে অনেকে ।

বন্ধুনি : ২০২২ সালে গোটা ভারতে মোট ১৯৪ জন সাংবাদিককে বিভিন্নভাবে আক্রমণ করা হয়েছে যার মধ্যে ৭ জন মহিলা সাংবাদিকও রয়েছেন। নিহত হয়েছেন ৮ জন । বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় এজেন্সি, রাজনৈতিক নেতা, কুখ্যাত অপরাধী ও সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীদের দ্বারা এই সাংবাদিকরা বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। কখনও এফআইআর দায়ের, কখনও পুলিশ দিয়ে সমন পাঠিয়ে, কখনও দেশের বাইরে যাওয়ার সময় ইমিগ্রেশনে আটক করে, কখনও গ্রেফতার করে, আবার কখনও সরাসরি শারীরিক হামলা করে বা প্রাণঘাতী হামলার হুমকি দিয়ে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

আমি : আচ্ছা, মহাভারতে আছে,  জরাসন্ধের আক্রমণে অতিষ্ঠ হয়ে কৃষ্ণ জরাসন্ধকে হত্যা করার জন্য ভীম আর অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে জরাসন্ধের কাছে গিয়েছিলেন।  তিনজনই ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে ছিলেন। জরাসন্ধ এই তিনজনের হাতে অস্ত্রব্যবহারের চিহ্ন দেখে প্রকৃত পরিচয় জানতে চাইলে, কৃষ্ণ তাঁদের প্রকৃত পরিচয় দেন। এরপর জরাসন্ধের সাথে ভীমের মল্লযুদ্ধ হয়। ভীম অনেক বার জরাসন্ধকে পরাজিত করেন , কিন্তু প্রতিবার জরাসন্ধ বেঁচে উঠে দাড়ান । এরপর কৃষ্ণের ইশারায় ভীম বিচ্ছিন্ন হওয়া দেহকে মিলিত হওয়ায় বাধা সৃষ্টি করলে জরাসন্ধ মারা যায় । সেটা কি দুর্নীতি নয় ?

বন্ধুনি : ওই ভাবে খুঁজলে মহাভারতে প্রচুর দুর্নীতি পাবেন । বলাই হয়, যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে ।

দুই

ব্রিটিশদের আগমনের আগে এদেশে এত নৈরাজ্য আর কখনো ছিল না। ভারতের কোথাও সাধারণত দুর্নীতি ও দারিদ্র্য দেখা যায়নি। যদি বলা হয় দারিদ্র্য, সাধারণ রাজনীতি ও প্রশাসনিক দুর্নীতি ব্রিটিশদের দান, তাহলে তাতে অত্যুক্তি হবে না । ব্রিটিশরা ভারতে এলে তারা ভারতকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং ঐশ্বর্যশালী দেখতে পায়। এমন একটি দেশে ব্রিটিশরা প্রতারণা, অনৈতিকতা ও দুর্নীতির মাধ্যমে রাজ্যগুলি দখল করে, অমানবিক কর আরোপ করে, কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্র্য ও অনাহারের গর্তে ঠেলে দেয় এবং ভারতের সমস্ত সম্পদ ও জাঁকজমক লুট করে ব্রিটেনকে ধনী করে। তারা মাদ্রাজ, কলকাতা এবং বোম্বেতে হিন্দু শাসকদের কাছ থেকে বাণিজ্য পদ ভাড়া করে এবং অনুমতি ছাড়াই সেখানে তাদের কামান ও সৈন্য মোতায়েন করে। ১৭৫৬ সালে, যখন বাংলার নবাব এমন আক্রমণ প্রতিহত করেন এবং ব্রিটিশ দুর্গ ফোর্ট উইলিয়াম আক্রমণ ও দখল করেন , তার এক বছর পরে, রবার্ট ক্লাইভ পলাশীর যুদ্ধে অংশ নেন।আমি বাংলাকে পরাজিত করে দখল করি এবং এক নবাবের সাথে আরেক নবাবের যুদ্ধ করে লুটপাট শুরু করি। মাত্র এক বছরে ক্লাইভ ১১ লাখ ৭০ হাজার ডলার ঘুষ নিয়ে বার্ষিক ১ লাখ ৪০ হাজার ডলার চাঁদা নিতে শুরু করেন। তদন্তে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, কিন্তু ব্রিটেনে চাকরির বিনিময়ে তাকে ক্ষমা করা হয়। উইল ডুরা লিখেছেন, ভারত থেকে ২০ লাখ টাকার পণ্য কেনা হয় এবং ব্রিটেনে এক কোটি টাকায় বিক্রি হয়। ব্রিটিশরা আওধের নবাবকে তার মা ও দাদীর ধন লুট করে ব্রিটিশদের 5 মিলিয়ন ডলার দিতে বাধ্য করে, তারপর এটি দখল করে এবং 2.5 মিলিয়ন ডলারে অন্য নবাবের কাছে বিক্রি করে।

নবাবের বিরুদ্ধে মির্জাফরসহ জগৎশেঠের গোপন ষড়যন্ত্রে অমিচাঁদেরও বড় হাত ছিল । পরে যখন ক্লাইভের সঙ্গে মির্জাফরযখন চুক্তির আলোচনা চলছিল, তখন অমিচাঁদ ব্রিটিশদের হুমকি দেন যে সিরাজ-উদ-দৌলার পদত্যাগের পর প্রাপ্ত রাজকোষের পাঁচ শতাংশ তাকে না দিলে তিনি নবাবের কাছে সমস্ত গোপনীয়তা প্রকাশ করবেন। অমিচাঁদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য দুটি চুক্তি প্রস্তুত করা হয়েছিল। একটি জাল, যেখানে অমিচাঁদকে পাঁচ শতাংশ শেয়ার রাখার জন্য গৃহীত হয়েছিল; দ্বিতীয় মূল, যেখানে এই অংশটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন জাল চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছিলেন। তারপর ক্লাইভ তাতে ওয়াটসনের স্বাক্ষর নকল করলেন, অমিচাঁদকে জাল চুক্তি দেখালেন, তাকে বোঝালেন। সমসাময়িক ইতিহাসবিদ ওরমি বলেছেন যে সিরাজ-উদ-দৌলার পদত্যাগের পর, যখন অমিচাঁদকে আসল পরিস্থিতি বলা হয়েছিল, তখন এই আঘাতের কারণে তার মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে যায় এবং কিছুক্ষণ পরে তিনি মারা যান। কিন্তু, ঐতিহাসিক বেভারিজের মতে, তিনি আরও দশ বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন, যার প্রমাণ হল তিনি ফাউন্ডলিং হাসপাতালে দুই হাজার পাউন্ড দান করেছিলেন, যার সাহায্য ‘কলকাতার কালো ব্যবসায়ী’ দেওয়ালে গৃহীত হয়েছে। তিনি লন্ডনের ম্যাগডালেন হাসপাতালেও অনুদান দিয়েছেন।

প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত, উৎকোচ  আর দুর্নীতি মানবসমাজকে চারিদিক থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে আর এখনও সমসাময়িক পৃধিবীর জটিল   সমস্যা। দ্য অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুসারে, দুর্নীতি হলো “ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের দ্বারা অসৎ বা প্রতারণামূলক আচরণ, সাধারণত ঘুষের সাথে জড়িত” ।  এই শব্দটা  এসেছে  লাতিন corruptus থেকে, যার মানে “মানুষকে কলুষিত করা  এবং ধ্বংস করা ।”   যেহেতু বিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, এটা এমন এক সমস্যা,  যা সমাধান করা অসম্ভব হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির মাত্রা অনুমান করা কঠিন, কারণ এই ধান্দাবাজি বেশ লুকিয়ে করা হয়। সমস্যাটা বিভিন্ন চিন্তকের দ্বারা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে আর এর কোনও মান্যতাপ্রাপ্ত সংজ্ঞা নেই। ঘুষ আর দুর্নীতি   ব্যক্তিগত লাভের জন্য সাধারণত সরকারি  অফিসে হয়, যদিও বেসরকারি স্তরে আয় করার জন্যও হয়, ভয় দেখিয়ে, যেমন, কারোর বিরুদ্ধে গাঁজা কেসে ফাঁসিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে টাকা তোলা ।  অসৎ আচরণের সর্বজনীন নিন্দা সত্ত্বেও দুর্নীতি একটা সামাজিক আর রাজনৈতিক প্রক্রিয়া । ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়;-এর দ্বিতীয় ভাগে বালক-বালিকারা জেনে যায় অসততা কাকে বলে। বিশ্বব্যাংক দুর্নীতিকে ব্যক্তিগত লাভের জন্য সরকারী কর্তৃত্বের অপব্যবহার হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।

অপরাধ ও দুর্নীতির এই প্রভেদ সম্পর্কে প্রাচীন ভারতের মানুষ যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাঁরা জানতেন যে অপরাধ ‘ধর্মনাশ’ করে কিন্তু দুর্নীতির ফলে ধর্মের ‘গ্লানি’ ঘটে। প্ৰাচীন ভারতের ঐতিহাসিক আয়ুর্বেদগ্রন্থ ‘চরক সংহিতা’য় ‘গ্লানি’ শব্দটিকে ‘বিকৃতি’ অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। ‘ধাতুবৈকল্য’ অর্থাৎ ‘বায়ু’, ‘পিত্ত’, ‘কফ’ প্রভৃতির বিকার থেকে দেহে যে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, একথাও সেখানে বলা হয়েছে। অতএব এই মন্তব্যের সূত্র ধরে দুর্নীতিকে একটি ‘সামাজিক ব্যাধি’ রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে । পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন সমাজ নেই যে সমাজকে এই ব্যাধি আক্রমণ করেনি। প্রাচীন ভারতীয় সমাজও এই রোগের ব্যতিক্রম ছিল না। বেদ-অধ্যয়ন শেষ করার পরে উপনিষদের প্রবীণ ঋষি তরুণ স্নাতকদের বলেছিলেন, “যানি অনবদ্যানি কর্মাণি তানি সেবিতাব্যানি নো ইতরানি” (কঠোপনিষদ) – অর্থাৎ, “নিন্দনীয় নয়, এমন কর্মই শুধু করবে। তদ্ভিন্ন অন্য কোন কর্ম করবে না।” অতএব, ‘নিন্দনীয় কর্ম’ প্রাচীন ভারতেও ছিল এবং সেটার বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সতর্ক করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও ছিল। এই নিন্দনীয় কর্মের মধ্যে  এমন কিছু কাজ ছিল, যা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে।

সংস্কৃত ও পালি সাহিত্যে একটি বিশেষ শব্দের সাহায্যে অপরাধকে দুর্নীতি থেকে পৃথক করা হয়েছিল। ‘সুত্তনিপাত’গ্রন্থে (১০৬.২.৭০, ৪১) অপরাধমূলক বৃত্তিগুলিকে বলা হয়েছিল ‘সাহস’। অতীতে যারা এ-ধরণের কাজ করে জীবন নির্বাহ করত, সেই ‘অপরাধজীবী’ (অর্থাৎ ভাড়াটে দস্যু, পেশাদার খুনী প্রভৃতি) লোকেদের বলা হয়েছিল ‘গূঢ়জীবী’। তারা ‘কূটযুদ্ধ’ ও ‘গুপ্তহত্যা’য় বিশেষ পারদর্শী ছিল। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে ‘তস্কর’ (চোর-ডাকাত), ‘গ্রন্থিছেদক’ (গাঁটকাটা), ‘গৃহভেদক’ (সিঁধেল চোর/ burglar), ‘অবরোধক’ (ঠগী বা ঠাঙাড়ে), ‘নৃশংসিন’ (খুনী) ইত্যাদি নানা ধরণের অসামাজিক লোকেদের কথা পাওয়া যায়। টাকা নিয়ে কাজ করবে, এরকম ‘পেশাদার গুন্ডা’র অভাব তখনও ছিল না। প্রাচীন গ্রীক ঐতিহাসিক ‘জাস্টিন’ , চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সৈন্যদের “Robbers and brigands of the day” আখ্যা দিয়েছিলেন। মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে তাদের আনুগত্য কেনা যেতো (“ধাতুবাদোপার্জিতেন দ্ৰবিণেন চণিপ্রসূ”, ৮ম অধ্যায়, ২৫৩-৫৪, পরিশিষ্টপর্বন)। অবশ্য দুর্নীতি আর দুর্নীতিগ্রস্ত লোকেদের কোন সঠিক প্রতিশব্দ প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে পাওয়া যায় না। ‘অধার্মিক’ শব্দটা এক্ষেত্রে উপযুক্ত নয়। অধার্মিক ব্যক্তি শুধু সমাজের শৃঙ্খলাভঙ্গ করে না, সে ‘শাস্বত এক মহাজাগতিক শৃঙ্খলা’ (ঋত) ভঙ্গ করে। এর জন্য তাকে ‘পাপের ভাগী’ হতে হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি যা করে, সেটা পাপও নয়, আবার অপরাধও নয়। ‘হীন স্বার্থান্বেষণ’ থেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্ম ।

বর্তমান দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, দুর্নীতির দুটো পরস্পর সম্পৃক্ত স্তর রয়েছে। সেই স্তরভেদ অনুযায়ী দুর্নীতি ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ (individualistic) কিংবা ‘সাংগঠনিক’ (organized) চরিত্রের হতে পারে। প্রাচীন ভারতে ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’, ‘সাংগঠনিক’ ও ‘মিশ্র’ – এই তিন ধরণের দুর্নীতি ছিল। ‘কথাসরিৎসাগর’ (৩৮.৪৭) গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে, ‘প্রপঞ্চবুদ্ধি’ নামের একজন ব্রাহ্মণ স্বয়ং রাজাকেই ঘুষ দিয়েছিল। ‘মহাভারতের’ ‘কালকবৃক্ষীয় উপাখ্যানে’ (সভাপর্ব, ১২০; ৭) একজন ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক গোপনে বিপুল সোনাদানা নিয়েছিল। ক্ষমতাধারী লোকেদের ‘উপধা’ (লোভনীয় বস্তুতে স্পৃহা) যে কতখানি মারাত্মক হতে পারে, ‘অর্থশাস্ত্র’ রচয়িতা ‘কৌটিল্য’ সেকথা বিলক্ষণ জানতেন। তাই অর্থশাস্ত্রে আমলাদের ‘উপধা পরীক্ষা’ (অর্থশাস্ত্র, ৪, ৪) করতে বলা হয়েছে।

 ‘যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি’ এমন অনেক ‘অর্থগৃধ্ন আচার্য’দের (তীর্থীক) কথা বলেছে (২.২৪১) যারা লোভনীয় পারিশ্রমিকের বদলে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করতেন ( এখন আমরা যা পশ্চিমবঙ্গে দেখছি )। এছাড়া ‘ভূয়া ওজন ব্যবহার’ (তুলাবিষম), ‘ভেজাল মাল সরবরাহ’ (পেটকম), ‘ক্রেতাকে ঠকানো’ (পিঙ্ক) ইওত্যাদি প্রাচীন ভারতেও অবাধে চলত (অর্থশাস্ত্র, ৪,২৩)। তখন ন্যায়-বিভাগেও এরকম কাজকারবার চালু ছিল। এখনকার মতন তখনও বিচারকরা অনেক সময়ে ধনী ব্যক্তিদের সপক্ষে রায় দিয়ে  বিচার প্রক্রিয়ার সততা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতো । স্মার্তরা তাকে ‘প্রকাশ্য তস্করতা’ (বৃহস্পতি স্মৃতি) আখ্যা দিয়েছিলেন।

বিচারকগণ যে উৎকোচের দ্বারা প্রলুদ্ধ হয়ে অবিচার করেন না, এটা বোধহয় আশা করতে পারি?” ‘মনুসংহিতা’র লেখক তাই বিচারককে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন –

“ধর্ম এব হস্তো হস্তি ধর্মো রক্ষতি রক্ষিত।

তস্মাৎ ধর্মো ন হন্তব্যো মানো ধর্মো হতোন্বধোৎ॥”

অর্থাৎ, “ধর্মকে বধ করলে তা স্বয়ং প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়,  আবার একে রক্ষা করলেই এ নিজেই রক্ষা করে। অতএব হে বিচারক, কদাচ স্বধর্মকে বিসর্জন দিওনা।”

 ‘নারদস্মৃতি’তে (৪.১১.১) ‘নিক্ষেপ’ বা ‘উপনিধি’র কথা বলা হয়েছিল, যেটার সোজা বাংলা মানে হয় – ‘পরের গচ্ছিত সম্পত্তি বেহায়ার মতন কব্জা করে নেয়া’। ‘পরদূষণ’ বা ‘পৈশূণ্য’ (vilification) করে অন্যের ভাবমূর্তি নষ্ট করাও তখন কিছু লোকের কাজ ছিল! ‘মহাভারতে’ (শান্তিপর্ব, ১৫.৪) এই ধরণের লোকেদের ‘নৃশংসবাদিন’ বলা হয়েছে। প্রাচীন ভারতের সাংগঠনিক স্তরে যে সব দুর্নীতি প্রচলিত ছিল, সেগুলো আরো সুক্ষ ও সুদূরপ্রসারী ছিল। কৌটিল্যীয় ‘অর্থশাস্ত্র’ এরকম বহু দুর্নীতিকে অঘোষিত ‘রাষ্ট্রনীতি’তে পরিণত করেছিল। সেখানে রাজাকে ‘সংঘভেদ’ (দল – ভাঙ্গানো), ‘গূঢ়পুরুষ অভিনিবেশ’ (গুপ্তচর লাগানো, প্রয়োজনে তাঁরা রাজদ্রোহী ব্যক্তিকে গোপনে হত্যা করতেন), ‘বিষপ্রয়োগ’ প্রভৃতি করতে বলা হয়েছিল। অতিরিক্ত করভার চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কোন অমাত্যকে ‘রাক্ষস’ বা ‘যক্ষ’ সাজিয়ে প্রজাদের মনে আতঙ্ক গড়ে তোলার  সুপারিশ অর্থশাস্ত্রে করা হয়েছিল।

চাণক্য তাঁর অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সরকারী কর্মচারীরা দু’ভাবে বড় লোক হয়। তারা হয় সরকারের সাথে প্রতারণা করে অথবা প্রজাদের উপর অত্যাচার করে’। অর্থশাস্ত্রের দু’টি অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, জিহবার ডগায় মধু থাকলে তা চেটে না থাকা যেমন অবাস্তব, তেমনি অবাস্তব হলো সরকারী তহবিল লেনদেন করে এতটুকুও সরকারের সম্পদ চেখে না দেখা’।

কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী সেজন্য লিখেছেন,

সরকার হইলো কাল,

খিল ভূমি লিখে লাল।

বিনা উপকারে খায় ধুতি

তিন 

৩১০০ থেকে ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে, প্রাচীন মিশরের প্রথম রাজবংশ তার বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতির জন্য কুখ্যাত ছিল। প্রাচীন গ্রীকরা “দুর্নীতি” শব্দটিকে একাধিক অর্থে প্রয়োগ করত । দুর্নীতি ব্যাপারটা তাদের কাছে ছিল সততা বা নৈতিক গুণ হারানোর ব্যাপার। প্রাচীন গ্রীকরা  বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির কথা বলেছে।

মূল্যবোধের  বিরুদ্ধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব এবং অসততার অভিযোগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটা কেবল নৈতিকতা আর সাধুতার বিষয় নয়। পঞ্চম শতাব্দীর গ্রীক সভ্যতায় যে দুর্নীতি প্রচলিত ছিল তা ছিল গণতন্ত্রের অবদান। সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রীক কবিরা ওডিসিতে শিক্ষা দেবার সময় বলতেন যে উপহার ছাড়া রাজকীয় বা অভিজাত দরবারে উপস্থিত হওয়া উচিত নয় এবং উপহার প্রত্যাখ্যান করা বুদ্ধিহীনের কাজ ।

 উসমানিয় রাজত্বের সময়ে, দুর্নীতি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে, অপরাধীদের বিচার করার জন্য দায়ী কর্মীরা তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্যও দায়ী ছিল না, এবং পর্যায়ক্রমে এই সরকারি কর্মকর্তারা অঞ্চলগুলোয়  ঘুরত। তাদের ক্ষতিপূরণের মধ্যে ছিল ফৌজদারি জরিমানা এবং স্থানীয় করের অংশ।  সপ্তম এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, ব্যাপারটা বদলে যায় আর । বার্কির লেখা A Case of Corruption within the Ottoman Bureaucracy প্রবন্ধে  ষোড়শ শতাব্দীতে অটোমান সাম্রাজ্য কীভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত পতনের কারণ হয়েছিল তার উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। সমীক্ষাটি ইঙ্গিত করে যে  অটোমান কর্মকর্তাদের মধ্যে  দুর্নীতির বিষয়টা সেই সময়ে গোপন ছিল না । তাদের নথিতে অটোমান কর্মকর্তারা বিভিন্ন ধরনের চাঁদাবাজি শুরু করেছিল, বিশেষ করে ব্যাবসা-বাণিজ্যে । উসমানীয় কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এবং সম্পদের অপব্যবহার সমাজে এতটাই প্রচলিত ছিল যে তা সমসাময়িক নাটকেও প্রতিফলিত হয়েছিল  । পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ অটোমান সেনাবাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করেছিল। গুন্ডুলি সমসাময়িক উসমানীয় কর্মকর্তাদের অবিশ্বস্ত, দুর্নীতিগ্রস্ত, লুঠতরাজকারী, বীভৎস, লম্পট এবং ভীতু  হিসাবে চিত্রিত করেছেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা আর  যোদ্ধার চরিত্রে  যে সমস্ত খারাপ বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে সেগুলি তাদের মধ্যে ছিল বলেই সাম্রাজ্যটির অবসান হয় । ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৬ পর্যন্ত সাম্রাজ্যজুড়ে বসবাসরত ১,০০,০০০ থেকে ৩,০০,০০০ আর্মেনীয় হামিদলান গণহত্যায় মারা যায় ।

 প্রাচীন রোমের রাজনৈতিক জীবনে দুর্নীতি বেশ উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছেছিল।  জুলিয়াস সিজার, যিনি ১০০ থেকে ৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত রাজত্য  করেছিলেন,  দুর্নীতিগ্রস্ত সেনেটকে নির্মূল করতে আর নতুন রোম গড়তে খুনোখুনি আর সোনাদানা খরচসহ যে কোনও উপায় ব্যবহার করার জন্য কুখ্যাত। রোম সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক দুর্নীতিকে খারাপ মনে করা হয়নি । পরিবর্তিত সামাজিক পরিস্থিতি দুর্নীতিকে মানুষের নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং দৈহিক কুফলগুলোকে রাজত্যকে দুর্বল করে দিচ্ছিল । রোম যখন খ্রিস্টধর্ম অবলম্বন করলো তখন টেন কমাণ্ডমেন্টস গুরুত্ব পেলো । কিন্তু ক্রমশ চার্চও দুর্নীতিতে আক্রান্ত হলে, প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের দরুন, রোমান ক্যাথলিক চার্চে  দুর্নীতির স্পষ্ট নিন্দা আরম্ভ হয় । দুর্নীতি সবসময় রোম সাম্রাজ্যের  সমস্যা ছিল । রোমের প্রজাতন্ত্র গড়ে উঠে ছিল দুর্নীতির ওপর। রোমানদের বিজয়গুলো দুর্নীতি দ্বারা চালিত হতো। প্রকৃতপক্ষে, রোম সাম্রাজ্য তার সবচেয়ে খারাপ সময়েও তার প্রজাতন্ত্রের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল ।  এখনকার দৃষ্টিতে রোমান  প্রজাতন্ত্র ছিল একটি মাফিয়া রাষ্ট্র এবং সেনেট তার কাউন্সিল অফ ডন। সাম্রাজ্য একটা  স্বৈরাচারের অধীনে  দুর্নীতিগ্রস্ত, বহুভুজ আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছিল, যেখানে বেশিরভাগ লোকেরা কেবল নিজেদের আর তাদের আত্মীয়স্বজনদের লাভের কথা ভাবতো। “ন্যায়বিচার” বিক্রি হতো রোমান সাম্রাজ্যে ।  জনসাধারণের জন্য তা ছিল  বিনোদন ।

​সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাথমিক পতন মূলত ভেতরে-ভেতরে দুর্নীতি আর উৎকোচের দরুন ঘটেছিল। তাইতো ভেঙে পড়তেই অজস্র কোটিপতির উদয় হলো ।  এটা এখন ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে, কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতি, যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন, বা  নিকারাগুয়া এবং তানজানিয়ার মতো অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের অনুকরণ করেছিল, তারা দুর্নীতিতে ভরপুর ছিল। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলো, বড় এবং ছোট, বাজারমুখী  দুর্নীতির  কারণে দুর্বল হয়ে গেছে, তাদের কাঠামো ভেঙে গেছে,  রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রী সহ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদরা তাদের সরকারি পদ হারিয়েছে; এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক শ্রেণী পালটে গেছে, যেমন পাকিস্তানে আর মালয়েশিয়ায়।  ব্যাপক ও নিয়ন্ত্রণহীন  দুর্নীতি অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যহত করে আর রাজনৈতিক বৈধতাকে ক্ষুণ্ন করে। তার সঙ্গে দুর্নীতির ফলে  সম্পদের অপচয় হয়, সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়, রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা হ্রাস পায় আর সরকারের প্রতি অবিশ্বাস বেড়ে যায়। উত্তর আমেরিকা আর আফ্রিকার বেশিরভাগ্ দেশ এই রোগে আক্রান্ত।দুর্নীতি দরিদ্র এবং সবচেয়ে দুর্বলদের উপর অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে, ব্যয় বৃদ্ধি করে এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং ন্যায়বিচারের মতো পরিষেবাগুলিো থেকে বঞ্চিত হয় ।

বর্তমান কালখণ্ডে বিশ্ব অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবার সাথে সাথে দুর্নীতিও বেড়ে গেছে। যেহেতু উৎকোচ ব্যাপারটা গোপনে ঘটে, তাই বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির মাত্রা এবং পরিধি অনুমান করা কঠিন।  বিশ্বব্যাংকের অনুমান  যে আন্তর্জাতিক ঘুষ প্রতি বছর মার্কিন ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা বৈশ্বিক জিডিপির ২% এবং মোট বৈশ্বিক সাহায্য বাজেটের ১০ গুণের সমতুল্য।।  নিম্নস্তরের ঘুষখোর সরকারি কর্মী থেকে শুরু করে কোটি কোটি ডলার হাপিশ-করা জাতীয় নেতার স্তর পর্যন্ত দুর্নীতি সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে তারা ভবিষ্যতের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ছিনতাই করে চলেছে। আবহমানকাল ধরে দুর্নীতি মানুষের ছায়াসঙ্গী। যেহেতু দুর্নীতির উৎপত্তি মানুষের মধ্যেই, তাই বাইরের জগতে এর সমাধানের সূত্র মিলবে না এবং যতদিন সমাধান সূত্র না পাওয়া যায়, ততদিন আদর্শ দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠন করা মানুষের আকাশকুসুম কল্পনা হয়ে থাকবে। 

দুর্নীতি একটা বিশ্বব্যাপী ঘটনা যা সমাজকে দারিদ্র্যের দিকে নিয়ে যায়, উন্নয়নে বাধা দেয় এবং বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে। তাছাড়া রাজনৈতিক ও বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করে, যার কাজ করা উচিত জনস্বার্থে । আইনের শাসনের অবনতি এবং জনগণের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকারি কর্মকর্তা ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা কমে যায়, যা আমরা ভারতবর্ষে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে প্রত্যক্ষ করে চলেছি । পানামা পেপারস প্রকাশ করেছে কিভাবে ভারতসহ সারা বিশ্বের ধনী লোকেরা তাদের চুরি-করা টাকাকড়ি বাইরের নানা দেশের অ্যাকাউন্টে জমা করে রেখেছে।  ২০১৬ সালে হওয়া পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারিতে অনেক ভারতীয় সেলিব্রিটি এবং ধনকুবের ব্যবসায়ীদের  নাম জড়িয়েছে। পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স লিক এর ঘটনায় ভারত সরকার গোপন অর্থের সন্ধান পেয়েছে, ভারতীয় মুদ্রায় এই পরিমাণ ২০,৩৫৩ কোটি টাকা। দেশের মানুষকে কালোটাকা উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় বসা মোদি সরকার আজও  কোনও সাফল্য পায়নি। 

চার

এ-কালের সমাজব্যবস্থার সঙ্গে ‘দুর্নীতি’র প্রশ্নটি এত গভীরভাবে জড়িয়ে গেছে যে সেটির উপস্থিতি ও প্রভাব সম্পর্কে কোন ধরনের প্রশ্নের অবকাশ নেই। অবচেতন মনে দুর্নীতিকে আমরা বোধহয় একটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই ধরে নিয়েছি। তাই দুর্নীতির ‘পরিভাষা’ ও দুর্নীতির ‘মাত্রা নির্ধারণ করবার নিরিখ’ সম্পর্কে আমরা খুব একটা কৌতূহলী নই। অথচ দুর্নীতি বিষয়ক যে কোনও তাত্বিক আলোচনা করতে গেলে দুর্নীতির অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটি বিশ্লেষণ করবার প্রয়োজন রয়েছে। সেজন্য প্রথমেই দুর্নীতির সহজ পরিভাষাটি জানা দরকার।  অনেকে মনে করেন প্রাক-ইসলামিক ভারতে দুর্নীতির বিবরণ পাওয়া গেলেও মূলত এদেশে মোটাদাগে দুর্নীতির সূত্রপাত হয় ইংরেজ শাসনামলে। সব ইংরেজ লর্ডরা দুর্নীতিবাজ না হলেও তারা এদেশে যে শাসনব্যবস্থা চালু করেছিল তা দুর্নীতির বেলাগাম সমারোহ ঘটায়। চিরস্হায়ী বন্দোবস্তের দরুন চাষির উদ্বৃত্ত সম্পদ জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা খাজনা ও নানা ধরনের চাঁদা যেমন, আবওয়াব, তুহুরি, দস্তরি, ভেট, নজরানা, বেগার, সালামি ইত্যাদি নামে পরিকল্পিতভাবে শোষণ করতো।                

দুর্নীতি ব্যাপারটা দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক, নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কোনও আদর্শের নৈতিক বা আধ্যাত্মিক অসাধুতা বা বিচ্যুতিকে বোঝায় । যেহেতু দুর্নীতি একটা জটিল ব্যাপার, কোনো একটা মাত্র  তত্ত্ব এর সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করতে পারে না। কিন্তু দুর্নীতি কেন হয়? ব্যক্তিগত লোভকে প্রায়ই সরকারি দুর্নীতির প্রাথমিক কারণ হিসাবে আমরা জানি , তবে এটা ব্যক্তি আর রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে জটিল সম্পর্কের অতি-সরলীকরণ। চিন্তকরা  বেশ কয়েকটা তত্ত্ব তৈরি করেছেন যা এই সম্পর্কগুলোকে বিনির্মাণ করতে সহায়তা করে। 

অর্থশাস্ত্রে দুর্নীতির সবচেয়ে জনপ্রিয় দুটি তত্ত্ব হল ‘প্রিন্সিপাল-এজেন্ট মডেল’ মানে আসল ঘুষখোর এবং ‘সংশ্লিষ্ট সংস্থা সমস্যা’ মানে দালাল ঘুষখোর । প্রিন্সিপাল-এজেন্ট মডেল অনুমান করে যে দালালরা (সরকারি কর্মকর্তা) মূল ঘুষখোরের (জনসাধারণ, সংসদ বা তত্ত্বাবধায়ক যেই হোক না কেন) স্বার্থ রক্ষা করে। বাস্তবে, দালালদের স্বার্থ প্রায়ই মূল ঘুষখোরের  স্বার্থ থেকে আলাদা হয় । দালালরা নিজের লাভ দেখতে চায় আর মূল ঘুষখোর হয়তো তার নিজের বা রাজনৈতিক দল বা আর্থিক সংগঠনের স্বার্থ রক্ষা করতে চায় । কলকাতায় আমরা একজন যুবতির বাড়িতে কোটি-কোটি দুহাজার টাকার গোলাপি নোটের পাহাড় দেখলুম ; জানতেও পারলুম যে যুবতিটি মূল ঘুষখোর নন – যে প্রৌঢ়ের সঙ্গে যুবতিটি সম্পর্কিত, সেও সম্ভবত মূল ঘুষখোর নয় । তত্ব এখানে পৌঁছে আটকে যায় । 

রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক মরিস বলেছেন, দুর্নীতি হল ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার। অর্থনীতিবিদ আই. সিনিয়র  একে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন, দুর্নীতি এমন একটা কাজ যেখানে অনৈতিক অর্থ প্রদানের কারণে, তৃতীয় কোনো পক্ষ সুবিধা পায়, যার ফলে তারা বিশেষ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার নিশ্চিত করে, এতে করে দুর্নীতির সাথে যুক্ত পক্ষটি এবং তৃতীয় পক্ষ উভয়ই লাভবান হয় এবং এই কাজে দুর্নীতিগ্রস্ত পক্ষটির হাতে থাকে আসল চাবিকাঠি । 

আরেক  দুর্নীতির তত্ব হলো, “আইনানুগ দুর্নীতি”, মানে যারা আইন বানায় তারা নিজেরা যাতে ফেঁসে না যায় তাই আইনটাতেই ফাঁকফোকর রাখে বেরিয়ে যাবার জন্য । মজার ব্যাপার হলো  নিজেদের রক্ষা করার জন্য আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনের ক্ষমতা আইন প্রণেতাদেরর হাতেই থাকে । ভারতে নির্বাচনের জন্য শিল্পপতিরা খোলাখুলি যেমন টাকা দেয় তেমনই লুকিয়ে দেয় যাতে ভবিষ্যতে দল বা লোকটা কাজে লাগে ।  একবার নির্বাচিত হলে, একজন রাজনীতিবিদ যিনি আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন,  একটি প্রাইভেট কোম্পানিকে সাহায্য করার জন্য এমন নিয়ম বা আইন পাশ করাতে চেষ্টা করেন যার লক্ষ্য  কোম্পানিটার আর্থিক চাপ কমানো।  সীমাহীন আর্থিক সহায়তা এবং স্বচ্ছতার অভাব একটা সমস্যা, কারণ প্রার্থীরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অবৈধভাবে কাজ না করলেও, এটা স্পষ্ট যে ব্যক্তিগত অনুদানের ব্যবস্হা রাজনৈতিক দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় । এইভাবে যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতিগ্রস্ত কারণ নির্বাচনী প্রচারের জন্য ব্যক্তিগত লেনদেনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্হা গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারী প্রভাবের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়।

আরেকটি তত্ব হলো, ইনফ্লুয়েন্স পেডলিঙ । ইনফ্লুয়েন্স পেডলিং হল সরকারে একজনের প্রভাব বা কর্তৃপক্ষের সাথে সংযোগ ব্যবহার করে অন্যের জন্য সুবিধা বা অগ্রাধিকার পাইয়ে দেবার অভ্যাস, সাধারণত টাকাকড়ির বদলে। ভারতে অস্ত্র কেনার সময়ে আমরা এই তত্বটা সহজে বুঝতে পারি । ‘হক ১১৫ অ্যাডভান্স জেট ট্রেনার’ বিমান কেনায় দুর্নীতির অভিযোগে দু’টি ব্রিটিশ সংস্থা রোলস রয়েস এবং ব্রিটিশ এয়ারোস্পেস সিস্টেমসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করল সিবিআই। পাশাপাশি, মামলা করা হয়েছে রোলস রয়েস ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর টিম জোনস এবং দুই ভারতীয় অস্ত্র ব্যবসায়ী সুধীর চৌধুরি ও তাঁর ছেলে ভানু চৌধুরির বিরুদ্ধেও। সিবিআইয়ের অভিযোগ, ২০০৪ সালে ওই বিমান কেনার সময়ে পদের অপব্যবহার করেছিলেন আমলাদের একাংশ। তাঁদের সঙ্গে হাত মেলান জোন্স, সুধীর, ভানু এবং ব্রিটিশ এয়ারোস্পেসের প্রতিনিধি। এছাড়া ২০০৯ সালে ৭৫ টি মৌলিক প্রশিক্ষণ বিমান (basic trainer aircraft) কেনা সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগে বিমান বাহিনীর (Air Force) অজ্ঞাতপরিচয় কর্মকর্তা, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (Defence Ministry) এবং অস্ত্র ব্যবসায়ী সঞ্জয় ভাণ্ডারি (arms dealer Sanjay Bhandari) ও সুইজারল্যান্ডের বিমান নির্মাতা পিলাটাস এয়ারক্রাফট লিমিটেডের (Swiss-based plane-maker Pilatus Aircraft Ltd) কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে সিবিআই (Central Bureau of Investigation)।  এই বিমান কেনার চুক্তিতে সিবিআই ৩৩৯ কোটি টাকার তছরুপের অভিযোগ এনেছে।  দিল্লি ও তার আশপাশের এলাকায় অভিযুক্ত সঞ্জয় ভাণ্ডারি ও অন্যদের মালিকানাধীন সম্পত্তিতে অভিযান চালায় সিবিআই (CBI)। সিবিআই সূত্রের খবর, আরও বহু জায়গাতেই অনুসন্ধান ও তল্লাশি চলছে। এফআইআরে, সিবিআই দক্ষিণ দিল্লির পঞ্চশীল পার্কে অস্ত্র বিক্রেতা সঞ্জয়ের মালিকানাধীন অফসেট প্রিন্টারের (Offset India Solutions Pvt Ltd) নামও উল্লেখ করেছে। সঞ্জয় ভান্ডারির ​​কার্যকলাপের উপর তদন্তের প্রথম ক্ষেত্রই প্রস্তুত হয় ২০১৬ সালের জুন মাসে। সুইস মৌলিক প্রশিক্ষণ বিমান (BTA) ভারতের অধিগ্রহণের বিষয়ে জড়িত ছিলেন তিনি। লন্ডনে ব্যবসায়ী রবার্ট বঢরার (Robert Vadra) জন্য বেনামী বা ভুয়ো মালিকানাধীন বাড়ি কেনার অভিযোগে ভাণ্ডারির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই তদন্ত চলছে। সুইস বিমান সংস্থাকে ভাণ্ডারির অফসেট ইন্ডিয়া সলিউশন প্রাইভেট লিমিটেড (Offset India Solutions Pvt Ltd) কোম্পানি ঠিক কোন ধরনের পরিষেবা দিত তাও খতিয়ে দেখছে তদন্তকারীরা ।

অতি সম্প্রতি, যৌথ কর্ম তত্ত্ব  ( Collective Action Theory ) একটি বিকল্প তত্ব হিসাবে আলোচিত হচ্ছে,  যে কেন পদ্ধতিগত দুর্নীতিকে  বেআইনি করে দেওয়া সত্ত্বেও টিকে থাকে এবং কেন দুর্নীতি কিছু দেশে অন্যান্য বিভিন্ন দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করে। যৌথ কর্ম তত্ত্ব ঐতিহ্যগত প্রধান-এজেন্ট ( Principal Agent )  সম্পর্কের বাইরে চলে যায় ।  বিশ্বাসের মতো বিষয়গুলোকে  গুরুত্ব  দেয় আর  ব্যক্তিরা লক্ষ্য রাখে যে অন্য লোকেরা কেমন আচরণ করছে ।  তাত্ত্বিকরা সিস্টেমিক দুর্নীতিকে একটি সমষ্টিগত সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করেন, কারণ লোকেরা একই পরিস্থিতিতে অন্যরা কী করবে তার উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে তাদের নিজস্ব আচরণকে যুক্তিযুক্ত মনে করে। দুর্নীতি যখন একটি সামাজিক নিয়মে পরিণত হয়, তখন সবাই একে সহজভাবে কাজ করার উপায় হিসেবে দেখতে শুরু করে। জনগণ ব্যাপক দুর্নীতির নেতিবাচক পরিণতি সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু তারা দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় কারণ তারা বিশ্বাস করে যে  দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থায় একমাত্র সৎ ব্যক্তি হওয়ার কোনো মানে হয় না । এই ধরনের পরিবেশে, প্রিন্সিপাল-এজেন্ট মডেলের উপর ভিত্তি করে দুর্নীতি বিরোধী ব্যবস্থা কার্যকর হবে না, কারণ এমন কোন “আদর্শ ক্ষমতাধর” নেই যারা দুর্নীতি বিরোধী নিয়মাবলীকে কড়া হাতে প্রয়োগ করবে।

আরেকটি তত্ব হলো Game Theory,  যা সরকারী ক্ষেত্রের দুর্নীতির ব্যাপকতা ব্যাখ্যা করে । এই তত্ত্বটি অর্থশাস্ত্র থেকে বক্তব্য ধার করে তৈরি এবং সরকারী কর্মকর্তাদের দ্বারা দুর্নীতিগ্রস্ত সিদ্ধান্ত নেবার যুক্তি দেয়। বিশেষ করে, দুর্নীতি একটি যুক্তিযুক্ত গণনা প্রণালীর অংশ এবং একটি অবিচ্ছেদ্য এবং প্রায়শই গভীরভাবে প্রোথিত পদ্ধতি যার দ্বারা লোকেরা সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রেক্ষাপটে, ব্যক্তিরা একটি  ( Prisoner’s Dilemma ) “বন্দীর দ্বিধা”-র মুখোমুখি হয়, যা ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর যুক্তিবাদীতার মধ্যে একটি দ্বন্দ্বকে চিত্রিত করে । ফেঁসে যেতে পারে ভেবে ঘুষদানকারী বা গ্রহণকারী  অসুবিধার আশঙ্কা করে । তার মনে হয় যদি সে ঘুষ দিতে বা নিতে  অস্বীকার করে অথচ  অন্য লোকেরা একই পরিস্থিতিতে দিব্বি সেটা করছে তাহলে  সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ।  মানে,  যদি দুর্নীতির উপায় অবলম্বন না করে তাহলে অন্যেরা যে সুবিধা পায় তার থেকে কম পাবে ।

বন্দীর দ্বিধা হল গেম থিওরিতে বিশ্লেষণ করা একটা খেলা। এটা  চিন্তার ভালো-খারাপ পরীক্ষার ব্যাপার যা দুটি সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী এজেন্টকে চ্যালেঞ্জ করে: প্রত্যেকে পারস্পরিক সুবিধার জন্য সহযোগিতা করতে পারে বা পৃথক পুরস্কারের জন্য তাদের সঙ্গীর সঙ্গে (“খারাপ”) বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে ।  বন্দীর দ্বিধা আমাদের দেখায় যে নিছক সহযোগিতা সবসময় একজনের স্বার্থে হয় না।বন্দীর দ্বিধাদ্বন্দ্বের দৃশ্যকল্পটি নিম্নরূপ কাজ করে: দুই সন্দেহভাজনকে একটি অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তারা এখন একটি থানায় পৃথক কক্ষে রয়েছে, একে অপরের সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। সরকারি উকিল আলাদাভাবে তাদের এই কথাগুলো বলেছেন:

এক : আপনি যদি স্বীকার করেন এবং অন্য সন্দেহভাজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে সম্মত হন, যিনি স্বীকার করেন না, তাহলে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হবে এবং আপনি মুক্ত হয়ে যাবেন।

দুই : আপনি যদি স্বীকার না করেন কিন্তু অন্য সন্দেহভাজন স্বীকার করেন, তাহলে আপনাকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে এবং প্রসিকিউশন সর্বোচ্চ  সাজা চাইবে।

তিন : যদি আপনারা দুজনেই স্বীকার করেন, আপনাদের দুজনকে কম কারাদণ্ড দেওয়া হবে।

চার : যদি আপনারা কেউই স্বীকার না করেন, তাহলে আপনাদের দুজনের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ আনা হবে এবং এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

সন্দেহভাজনদের কি করা উচিত? এটি বন্দীর দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সারমর্ম।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ভারতের মতো বেশিরভাগ দেশে, ঘুষের দোষে দোষী সাব্যস্ত হলে, ঘুষখোর এবং ঘুষদাতাদের সমানভাবে শাস্তি দেওয়া হয় (সমন্বিতভাবে)। অন্যদিকে, চীন, জাপান এবং রাশিয়ার মতো দেশে, ঘুষদাতার চেয়ে ঘুষখোর প্রায়শই  কঠোর শাস্তি পায়। এই প্রেক্ষাপটে, চিন্তকরা  মনে করেন ভারতকে হয়রানিমূলক ঘুষের জন্য  শাস্তি দেয়া বন্ধ করা উচিত কারণ ঘুষদাতাদের ঘুষের রিপোর্ট করার কোন প্রণোদনা থাকে না । এই প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে, ঘুষ নেওয়ার পরে, ঘুষদাতা এবং ঘুষখোর আর একই নৌকায় থাকে না, তাই রিপোর্ট করবে কিনা তা তাদের পছন্দ হতে পারে। ঘুষদাতারা রিপোর্ট করে উপকৃত হতে পারে কারণ তারা তাদের টাকা ফেরত পেতে পারে । ঘুষখোররা ঘুষ হারানোর এবং  শাস্তি পাওয়ার ঝুঁকি নেয় । 

যদিও প্রাগুক্ত প্রস্তাব তাত্ত্বিকভাবে সমস্যার সমাধান করতে পারে, ঘুষের ঘটনার বাস্তবতা অনেক বেশি জটিল। উদাহরণস্বরূপ, ঘুষদাতারা যারা রিপোর্ট করাকে বেছে নেয় তাদের ভাবতে হবে যে ঘুষখোর লোকটা সুযোগ পেলেই  প্রতিশোধ নেবে ।  এছাড়াও,  যারা সরকারী কর্মকর্তাদের  নিয়মিত ঘুষ দেয় তারা রিপোর্ট করার মাধ্যমে তাদের সুনাম এবং ভবিষ্যতের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে পারে। রিপোর্ট করার জন্য এবং রিপোর্টিং না করার জন্য এই সমস্ত কারণগুলিকে গণনা করা দরকার। 

আরেকটা হলো প্রাতিষ্ঠানিক তত্ব ( Institutional Theory ). দুর্নীতির একটি প্রাতিষ্ঠানিক বা সাংগঠনিক সংস্কৃতি সামাজিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুর্নীতিকে স্বাভাবিকীকরণের দিকে নিয়ে যায় এবং আনুষ্ঠানিক দুর্নীতিবিরোধী নিয়ম লঙ্ঘন বা উপেক্ষা করার জন্য দায়মুক্তির দিকে পরিচালিত করে। এই পরিস্থিতিতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য, সমষ্টিগত এবং সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজন, যেমন সংস্কার জোট বা সমমনা সংগঠনগুলির সক্রিয় জোট। এই পন্থাগুলিকে প্রায়ই “সম্মিলিত কর্ম” উদ্যোগ বলা হয়।প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্ব অনুযায়ী  সরকারী খাতে দুর্নীতি ব্যাখ্যা করার জন্য দেশ এবং সরকারী প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যবহার করে, যেমন আইনের প্রাক-বিদ্যমান শাসন, সুসংজ্ঞায়িত দুর্নীতি-বিরোধী নিয়মাবলী, এবং প্রয়োগকারীর ক্ষমতাসহ স্বাধীন দুর্নীতি-বিরোধী প্রতিষ্ঠান।  দুর্নীতি বোঝার ক্ষেত্রে, প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্ব সামাজিক প্রেক্ষাপটকে আলোচনায় নিয়ে আসে এবং দুর্নীতিবিরোধী কাঠামোর অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও কীভাবে সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং সমাজে দুর্নীতি প্রবেশ করতে পারে তা বোঝার জন্য একটি শ্রেণিবিন্যাস তৈরি করে। প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্ব বিবেচনা করে যে দুর্নীতি ব্যাপারটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং এর প্রতিষ্ঠানগুলির চরিত্র, নকশা এবং স্বচ্ছতাকে কীভাবে ও কতোটা প্রভাবিত করে। একই সাথে, তা  স্বীকার করে যে দুর্নীতি, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সংস্কৃতি এবং লিঙ্গের মধ্যে সম্পর্কগুলো মোটেই সহজ নয় ।

 রাজনৈতিক দুর্নীতির “প্রাতিষ্ঠানিক” তত্ব অনুযায়ী  দুর্নীতি ব্যক্তিগত স্তরে ঘটতে পারে, এটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রকৃতির ক্ষেত্রেও হতে পারে যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে গঠন করা হয় যা তাদের মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় ।  দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হল ভারতে রাজনৈতিক প্রচারণার ব্যক্তিগত অর্থায়ন।ভারতের রাজ্যগুলিতে, নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের সাধারণ নাগরিক, ব্যক্তিগত কর্পোরেশন এবং সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর মতো বিভিন্ন ব্যক্তিগত উৎস থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এইভাবে এমন  ঘটতে দেখা যায় যে, একবার নির্বাচিত হলে, একজন রাজনীতিবিদ যিনি আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন, কোনো প্রাইভেট কোম্পানিকে নিয়ম টপকাতে সাহায্য করে আর কোম্পানিটার আর্থিক চাপ কমিয়ে দেয়। এই ব্যাপারে আমরা আমবানি-আদানিদের নাম শুনি । বোঝাই যাচ্ছে সীমাহীন আর্থিক সহায়তা আর স্বচ্ছতার অভাব একটা জটিল সমস্যা কারণ প্রার্থীরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অবৈধভাবে কাজ না করলেও, এটা স্পষ্ট যে ব্যক্তিগত অনুদানের অনুশীলন রাজনৈতিক দুর্নীতির জন্য সংবেদনশীল। এইভাবে যুক্তি দেওয়া যেতে পারে যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতিগ্রস্ত কারণ “নির্বাচনী প্রচারের জন্য ব্যক্তিগত তহবিল গ্রহণের প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলন গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারী প্রভাবের উপর নির্ভর করে”।

দুর্নীতি ভারতে একটা ভয়ংকর সমস্যা , এতটাই, যে লোকেরা একে স্বাভাবিক হিসাবে গ্রহণ করেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে, পশ্চিমবঙ্গে, ব্যাপারটা নতুন উচ্চতা স্পর্শ করেছে। ভারতের যেকোন রাজ্যে,  কোনও সরকারি অফিসে গেলে, আপনার কাজ করার জন্য, সংশ্লিষ্ট লোকটি জানিয়ে দেবে কতো টাকা দিতে হবে । সবাই দেয় বলে আপনিও দেবেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে, আপনি যদি কোনও সরকারি অফিসে যান, সংশ্লিষ্ট কর্মী বা অফিসার খোলাখুলি বলবে না কতো টাকা চাই ; সাধু সেজে বসে থাকবে , কাজও করবে না। তাই পশ্চিমবঙ্গে চোরদের সম্মানের খুব অভাব।  প্রকাশ্যে ঘুষ চাইবে না, কোনো কাজ করবে না। যাইহোক, প্রকল্পগুলি অনুমোদন করা হয়, প্রকল্পের জন্য অর্থ মঞ্জুর করা হয়, এবং সরকারী দপ্তর থেকে নিয়মিতভাবে স্বাক্ষর করা হয়,  প্রকল্পের কোনো বাস্তবায়ন ছাড়াই। এটি এখন পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে, যা আগে অজানা ছিল। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশও এই Collective Action Theory-র আওতা থেকে বাদ যা্য় না । সব রাজ্যেই পুলিশ বাহিনী দুর্নীতিগ্রস্ত । যে রাজ্য যতো ধনী সেই রাজ্যে পুলিশ ততো দুর্নীতিগ্রস্ত ।  পুলিশকে একজন অপরাধীও ঘুষ দিয়ে এনকোয়ারি বন্ধ করিয়ে দিতে পারে । অনেক রা্জ্যে পুলিশকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি বলে অপরাধিরা লকাপেই মারা পড়েছে ।

আরেকটি তত্ব হলো Greasing The Wheels Theory ; এই তত্ব অনুযায়ী বিশ শতকের প্রথমার্ধে মনোবিজ্ঞানের  আচরণগত কার্যকারিতা প্রয়োগ করে দুর্নীতির সামলানোর চেষ্টা হয়েছে।  রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, দুর্নীতির কার্যকারিতাবাদী ব্যাখ্যা দুর্নীতিকে ‘চাকায় তেল দেয়ার’ উপায় হিসাবে দেখেছে, বিশেষত বিনিয়োগকারী এবং কোম্পানিগুলির জন্য। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, দুর্নীতি হল  নিয়ন্ত্রন, সম্পদ বণ্টন এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তৈরির মাধ্যমে দ্রুত তেল দিয়ে মসৃণ কায়দায় বেরোনোর উপায়। ধীরুভাই আমবানি এই উপায়ে একটা পুরো ফ্যাক্ট্রি গুজরাতে এনেছিল, অর্থমন্ত্রী আর মন্ত্রকের আমলাদের চাহিদা অনুযায়ী তেল দিয়ে। তার কারণ তখনও পর্যন্ত নেহেরুর নানা রকমের আমদানি নিয়মকানুনে কাজ আটকে যেতো ।

পাঁচ

পশ্চিমবঙ্গ এখন দুর্নীতি-উৎকোচ আর নানা রকম ঘুষের আখড়া । স্কুলের চাকরি থেকে ত্রাণের ত্রিপল; বালি-পাথর-কয়লা থেকে গরু; নির্মাণ সামগ্রী থেকে হাসপাতালের শয্যা, যে দিকেই চোখ পড়বে, সর্বত্রই লুটপাট আর ঘুষখোরি । এই রাজ্যে দুর্নীতির একটি নির্দিষ্ট ছক এখন অতি স্পষ্ট— সেই ছকটির নাম রেন্ট সিকিং বা খাজনা আদায়। যেখানে যাঁর হাতে যতটুকু ক্ষমতা, তিনি তা ব্যবহার করে কোনও না কোনও অন্যায়কে চলতে দিচ্ছেন— বস্তুত, সেই অন্যায়কে প্রত্যক্ষ সুবিধা করে দিচ্ছেন— এবং বিনিময়ে খাজনা আদায় করে চলেছেন। এই ক্ষেত্রে ‘খাজনা আদায়’টি অন্যায়, কারণ জমি, বাড়ি বা যন্ত্রপাতির মতো ন্যায্য মালিকানায় থাকা সম্পদ নয়, এই ক্ষেত্রে খাজনা আদায় করা হয় রাজনৈতিক, প্রশাসনিক বা সামাজিক ক্ষমতা থেকে, যার মালিকানা তাঁদের নয়। তাঁরা নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেনিয়মকে চলার পরিসর তৈরি করে দেন, এবং তার বিনিময়ে সেই বেনিয়ম থেকে উপার্জিত অর্থের বখরা পান। পশ্চিমবঙ্গে এই প্রক্রিয়াটি এখন সম্পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে উঠেছে— প্রকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থার সমান্তরাল একটি কাঠামো। শাসক দলের এমন কোনও নেতার সন্ধান পাওয়া এখন দুষ্কর, যিনি সচেতন ভাবে এই অন্যায়ের বাইরে থাকেন, থাকতে চান। এই প্রবণতার মূল্য চোকাতে হয় রাজ্যের সাধারণ মানুষকে। দুর্নীতির দুর্বিপাকে ঘুরে মরাই পশ্চিমবাংলার মানুষেরা  ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন।

প্রশ্ন হল, দুর্নীতি এমন সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে কোন মন্ত্রবলে? গত চল্লিশ বছরে যা  পশ্চিমবঙ্গে বারে বারেই শোনা গিয়েছে—তা হলো,  শাসক দলের হয়ে রাজনীতিই এখন এই রাজ্যে চাকরি-বাকরি পাবার একমাত্র উপায় ।  চল্লিশ বছর ধরে শোনা যাচ্ছে “পার্টি করি”, মানে যা কিছু অনৈতিক সেইসব কম্মো করে বেড়াই।  শাসক দলের খুরের দাগ নিজের পোঁদে লাগাতে পারলেই খাজনা আদায়ের যন্ত্রে লেগে যাও। পুলিশ-প্রশাসন ইত্যাদির ঝামেলা নেই— , খাজনার ভাগ পেলেই তারা তুষ্ট।  বড় মাপের কর্মসংস্থান হতে পারে, এমন কোনও উৎপাদনশীল ক্ষেত্র এই রাজ্যে নেই। সবাই পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে অন্য রাজ্যে পালিয়েছে। টোপ ফেললেও গিলছে না । ফলে, রাজনীতির ঘোলা জলে মাছ ধরা ছাড়া  উপায়া নেই।  বহু বছর ধরে বেঙ্গালুরু, দিল্লি-নয়ডা-গুরুগ্রাম, অথবা হায়দরাবাদ, মুম্বই— ভারতের যে কোনও বড় শহরে উচ্চপদে যারা চাকরি করছে তাদের  মধ্যে বাঙালির অনুপাত চোখে পড়ার মতো। পশ্চিমবঙ্গে কাজ নেই বলে অদক্ষ শ্রমিকরাও ভিনরাজ্যে গিয়ে বাসা বেঁধেছে।

পশ্চিমবঙ্গের এখনকার দুর্নীতি আসলে  প্রশাসনের উন্নয়ননীতির ব্যর্থতা থেকে জন্মেছে ।  পঞ্চায়েতের জন্য যে বিপুল পরিমাণ অর্থ আসে, তার অঙ্কটা বিশাল। এইসব উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের ভাগ পাওয়ার লোভেই পঞ্চায়েত ভোটে জিততে মরিয়া হয়ে ওঠেন প্রার্থীরা, সেজন্যই এত খুনোখুনি হয় এই নির্বাচনে। নাহলে, একজন পঞ্চায়েত সদস্যর মাসিক বেতন হাজার তিনেক টাকা, এই সামান্য টাকা বেতনের কাজের জন্য কেউ এতটা মরিয়া হয়ে ওঠে না । ১৯৭৮ সালে যখন থেকে পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তখন থেকেই বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল অঙ্কের টাকা আসতে শুরু করে। একেকটা প্রকল্পের জন্য কয়েকশো কোটি টাকাও আসে, আর প্রকল্পের সংখ্যাও কম নয় । বরাদ্দকৃত এই বিপুল অর্থে যে দুর্নীতি হচ্ছে, সেটা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন দেখিয়েছিলেন রাজীব গান্ধী। তিনি হিসাব দিয়ে বলেছিলেন কেন্দ্র একটা প্রকল্পে যত অর্থ বরাদ্দ করে, তার ৮০ শতাংশ আর শেষ মানুষটি পর্যন্ত পৌঁছয়ই না।  পঞ্চায়েত স্তরে দুর্নীতি বামফ্রন্ট আমল থেকেই হয়ে আসছে। তাই সেই সময়েও পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেতার জন্য হিংসার আশ্রয় নিত দলগুলি। পঞ্চায়েতের দুর্নীতিতে প্রতিটা রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরাই জড়িত আছেন, কেউ কম কেউ বেশি । কোনও দল বলতে পারবে না যে তাদের পঞ্চায়েত সদস্যরা দুর্নীতি করেন না। 

পঞ্চায়েত স্তরের দুর্নীতিটা চালু হয়েছিল বামফ্রন্টের আমল থেকেই। তখনই পঞ্চায়েতকে ঘিরে দুর্নীতি একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। কিভাবে দুর্নীতি হয় পঞ্চায়েতে? গ্রামাঞ্চলে এখন সবথেকে বড় দুর্নীতির জায়গা হচ্ছে আবাস যোজনা। এই প্রকল্পে একেকটি পরিবার পাকা ঘর তৈরির জন্য এক লাখ ৬৭ হাজার টাকা করে পায়। এই অর্থ পাওয়ার জন্য পঞ্চায়েত সদস্যকে দিতে হয় ১০ শতাংশ অর্থ। এটাই চলতি রেট। এছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া, বাড়ির সামনে রাস্তা করিয়ে দেওয়া, ব্যাঙ্ক ঋণ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা – এসব থেকেও প্রচুর আয় করেন একেকজন পঞ্চায়েত সদস্য। পঞ্চায়েত সদস্যদের আরেকটা বড় রোজগারের পথ হল বিভিন্ন ধরনের সার্টিফিকেট প্রদান করা। হাজার হাজার মানুষ অন্য রাজ্যে কাজ করতে যান, তাদের রেসিডেন্ট সার্টিফিকেট প্রয়োজন হয়। সেটার জন্য টাকা নেওয়া হয়। 

পঞ্চায়েত সদস্যদের সম্প্রতি আরেকটা বড় রোজগারের পথ হয়ে উঠেছে গ্রাম্য সালিশিগুলো । পারিবারিক ঝামেলাতেও মাথা গলান পঞ্চায়েত সদস্যরা। আর সেখানে বিচারের একমাত্র মাপকাঠি হল যে পক্ষ বেশি অর্থ দিতে পারবে, রায় তার পক্ষেই যাবে। আবার সাধারণ মানুষও দুর্নীতিতে যুক্ত থাকে অনেক সময়ে। মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ রোজগার প্রকল্প, যে প্রকল্প ‘১০০ দিনের কাজ’ হিসাবেই পরিচিত, সেখানে রাস্তা বা পুকুর না কেটেই তার জন্য বরাদ্দ অর্থ তুলে নেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে গ্রামের যে বাসিন্দা টাকা পাচ্ছেন, তার আর পঞ্চায়েত সদস্যর মধ্যে আধাআধি ভাগ হয় টাকাটা।

 বিবিসির প্রতিবেদন জানিয়েছ, একেক জন গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য তার পাঁচ বছরের মেয়াদে অন্তত ৫০ লক্ষ টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে রোজগার করে , এবং এটা শুধুমাত্র সরকারি প্রকল্পগুলোর টাকা গ্রামের মানুষকে পাইয়ে দেওয়ার বদলে। এর বাইরে তো রাস্তা তৈরি বা অন্যান্য কাজের বরাদ্দ যারা পায়, সেইসব ঠিকাদারদের কাছ থেকেও টাকা তোলে পঞ্চায়েত সদস্যরা। অথচ তাদের সরকারী বেতন মাত্র হাজার তিনেক টাকা, তো এই বিপুল অর্থের হাতছানি যেখানে, সেখানে খুনোখুনি-মারামারির আশ্রয় তো নেবেই। আবার পঞ্চায়েত সদস্যদের নিজস্ব বাহিনীও থাকে। এরা ভোটের সময়ে তাদের ‘দাদা’র হয়ে কাজ করে আর বছরভর নানা সিণ্ডিকেট ব্যবসা ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত থাকে। কংগ্রেস আমল বা বামফ্রন্ট আমলেও এই বাহিনী ছিল। তাদের কখনও বাস-মিনিবাসে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে রোজগারের পথ করে দেওয়া হয়েছিল, কখনও রিকশা-অটোরিকশার পারমিট করিয়ে দিয়ে আয়ের পথ করে দেওয়া হয়েছে, আর এখন নির্মাণ সিণ্ডিকেটের মতো আইন বহির্ভূত, সমান্তরাল অর্থনৈতিক কাজে ব্যবহার করা হয়। বিনিময়ে ভোটের সময়ে হুমকি-লেঠেলবাজি আর সন্ত্রাস করানো হয় এই লুম্পেন বাহিনীকে দিয়েই।

ছয়

সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত দেশ  স্বপ্নে দেখা যায়। কিন্তু পৃথিবীর এমন কিছু দেশ রয়েছে, যেখানে দুর্নীতিই প্রথম ও শেষ কথা। দুর্নীতির সেই সমস্ত দেশের ভিত ।  ট্রান্সপারেন্সির এক জরিপে দেখা যায় যে, দুর্নীতিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এই হিসাবটি করা হয় ১০০ পয়েন্টের ভিত্তিতে। যে দেশ যত দুর্নীতি মুক্ত সে দেশের পয়েন্ট তত বেশি। হিসাবে দেখা যায় যে, সবচেয়ে পিছিয়ে আছে সোমালিয়া। এ দেশের পয়েন্ট ১০০ তে মাত্র ১০। এরপর কয়েকটি দেশের পরে আছে সিরিয়া। এর পয়েন্ট মাত্র ১৩। এরপর ১৪পয়েন্ট নিয়ে অবস্থান করছে লিবিয়া, সুদান ও ইয়েমেন। এরপর ইরাকের আছে ১৭, লেবাননের আছে ২৮।

 আরব বিশ্বের নয়টি দেশ ও ভূখণ্ডে (ফিলিস্তিন) গত বছর দুর্নীতির পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বলে মনে করে সেখানকার সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে গভীর সংকটে পড়া লেবানন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনের অবস্থা বেশি খারাপ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে, প্রায় ১১ হাজার অংশগ্রহণকারীর মতামতের ভিত্তিতে পাওয়া জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, এ অঞ্চলের দুর্নীতি বেড়ে যাওয়া অন্য দেশ ও ভূখণ্ড হলো আলজেরিয়া, মিসর, জর্ডান, মরক্কো, ফিলিস্তিন, সুদানতিউনিসিয়া। অংশগ্রহণকারীদের ৬১ শতাংশ এসব দেশে গত বছর দুর্নীতি বেড়ে গেছে বলে জানান । ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশানালের মতে,  ‘আরব বসন্ত’ শুরুর পর প্রায় অর্ধদশক পেরিয়ে গেলেও বিশ্বব্যাপী  দুর্নীতির পরিমাপে দেখা গেছে, সরকারি খাতের দুর্নীতি কমাতে বিভিন্ন সরকারের প্রচেষ্টা নিয়ে এখনো সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে। দুর্নীতিবিরোধী এ সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, আরব দেশগুলোর অধিকাংশ নাগরিক মনে করেন, সম্প্রতি এসব দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। আবার অনেকে মনে করেন, সরকারি কর্মকর্তা ও পার্লামেন্ট সদস্যরা ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে লেবাননের ৯২ শতাংশ, ইয়েমেনের ৮৪ শতাংশ, জর্ডানের ৭৫ শতাংশ মনে করেন দেশগুলোতে দুর্নীতি বেড়েছে। বিপরীতে মিশরের ২৮ শতাংশ ও আলজেরিয়ার ২৬ শতাংশ মনে করেন তাঁদের দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। জরিপে যাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ ইয়েমেনি ও প্রায় অর্ধেক মিশরীয় বলেন, সরকারি সেবা পেতে তাঁদের ঘুষ দিতে হয়েছে। একই কথা বলেন তিউনিসিয়ার ৯ শতাংশ ও জর্ডানের ৪ শতাংশ সাক্ষাৎকার প্রদানকারী।

জরিপ প্রতিবেদনের রচয়িতা কোরালাই প্রিং বলেন, তাঁরা লেবাননের দুর্নীতি পরিস্থিতি নিয়ে বিশেষ উদ্বিগ্ন। গভীর রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্যে দেশটি ২০১৪ সালের মে থেকে কোনো প্রেসিডেন্ট ছাড়াই চলছে। কোরালাই আরও বলেন, বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে জনগণ যে শুধু দুর্নীতি রোধে সরকারি প্রচেষ্টাতেই তাঁদের প্রচণ্ড অসন্তোষ জানিয়েছেন তা-ই নয়, বরং সরকারি খাতজুড়ে দুর্নীতির উচ্চহারেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া। শান্তি ও সমৃদ্ধি আর সৌন্দর্যের জন্যে একসময় যে দেশকে বলা আফ্রিকার সুইজারল্যান্ড, আজ সেই দেশ এক বিভীষিকার নাম। সোমালিয়ার নাম শুনলেই সবার চোখে ভাসে যুদ্ধ বিগ্রহ আর জলদস্যুদের কথা। অথচ সোমালিয়ার রাজধানী শহর মোগাদিসুর রয়েছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস। সেমালিয়াতে জলদস্যু ‘ব্যবসা’ এখন রমরম করছে। দুবাই এবং অন্যান্য দেশে থাকা সোমালিরা বিনিয়োগ করছে এই ব্যবসায়। সোমালি জলদস্যুদের লুট করা টাকায় বন্দর ঈলে বিশাল-বিশাল ভিলা এবং হোটেল তৈরি হয়েছে। এক সময়কার গরীব জেলেরা এখন মার্সিডিজ বেঞ্জ হাঁকাচ্ছে। দলে দলে দরিদ্র জেলে ছেলেরা জলদস্যু দলে নাম লেখানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এই ব্যবসার আসল লোকজনেরা রয়েছে পর্দার আড়ালে । অন্য সব ব্যবসার মতই জলদস্যুদের হাতে টাকার খুব সামান্য অংশই যায়। বেশিরভাগ অংশটাই চলে যায় নেপথ্যের কারবারীদের কাছে। দুর্নীতি দেশটির রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। নানা রকমের সমস্যায় নিমজ্জিত সোমালিয়া বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এদেশের মাত্র ২৯ শতাংশ ছেলে-মেয়ে স্কুলে যেতে পারছে। অবৈধ ব্যবসা, অপহরণ, মুক্তিপণের এক দেশ হয়ে উঠেছে  সোমালিয়া।

আরেকটা দেশ হলো সুদান যেখানে মানবাধিকার বলতে কিচ্ছু নেই। এখন আবার দেশ দখলের জন্য দুই সেনাপ্রধানের যুদ্ধ চলছে । দুর্নীতি, গণমাধ্যমের উপর আঘাত, অস্বচ্ছ নির্বাচন, মানবাধিকার সংগঠনগুলির ওপর প্রতিনিয়ত আক্রমণ, এমনই নানা অভিযোগে বিদ্ধ দক্ষিণ সুদানের সরকার। অভিযোগ অবশ্য আজকের নয়, দীর্ঘদিন ধরে বহু প্রতিবেদনে বার বার উঠে এসেছে সুদানের ভয়াবহ প্রসঙ্গ৷ এমনকী সে দেশে  রয়েছে গোপন জেল ! বহু মানবাধিকার কর্মীকে সেই সমস্ত জেলে দীর্ঘদিন আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। কিন্তু কোনও অভিযোগই মানতে রাজি নয় সুদান সরকার৷ সরকারের দাবি, সুদানের মানবাধিকার নাকি বিশ্বের বহু দেশের কাছে দৃষ্টান্ত হতে পারে। যদিও গণহত্যা’র কারণে সুদানের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছিল আন্তর্জাতিক আদালত। তবে ওই পর্যন্তই। যদিও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, আফ্রিকান কমিশন অন হিউম্যান অ্যান্ড পিপলস রাইটসের মতো সংগঠন বারংবার তাদের প্রতিবেদনে সুদানের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করেছে। উঠে এসেছে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির কথা। ছাত্র, বিরোধী রাজনীতিক, মানবাধিকার কর্মী সবাইকে আটকে রেখে সুদান হয়ে উঠেছে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। এমনকী মানুষকে শায়েস্তা করতে গরিবের খাবার রুটির দামও মারাত্মক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

আরেকটা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ, যে দেশটার নাম বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভয়ংকর জঙ্গিগোষ্ঠী আইসিস-এর কথা। আর শুধু কি সন্ত্রাস, সিরিয়া দেশটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত শুধুই দুর্নীতি। প্রায় এক যুগ ধরে সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে। এদিকে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ইদলিবে সেনা উপস্থিতি নিয়ে চরম উত্তেজনা চলছে। কখনও আইসিস-রাজ, কখনও বা শাসক আসাদ-গোষ্ঠীর অত্যাচার, সিরিয়ার মানুষের জীবন কার্যত নরকযন্ত্রণায় পরিণত হয়েছে। এমনকী দুর্নীতিতে এতটাই নিমজ্জিত সে দেশ, যে জনসাধারণকে ওষুধ কিনতে হয় ঘুষ দিয়ে। বাশার আল-আসাদের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন কম হয়নি সে দেশে। কিন্তু তা প্রতিহত করতে রাষ্ট্রক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করেন সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি আসাদ। বেকারত্ব, দুর্নীতি, মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক স্বাধীনতায় রাষ্ট্রের বাধা, সিরিয়ায় এখন বাশার আল-আসাদের ‘একনায়কতন্ত্র’ চলছে। সেইসঙ্গে ‘আইসিস’ নামের আতঙ্ক। 

বলা হয়ে থাকে, ইয়েমেনের অধিকাংশ শিশুর পেট ভরে ডাস্টবিনের খাবার খেয়ে। সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী একটা সময় বলেছিলেন, ‘পরবর্তী খাবার কখন পাওয়া যাবে তা নিয়ে সবসময়ই অনিশ্চয়তায় থাকে দেশটির লাখ লাখ শিশু৷ আমি একটি হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম, যেখানে শিশুরা ক্ষুধায় এত দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে, তাঁরা কাঁদতেও পারছিল না।’ সেই দেশটির রন্ধ্রে-রন্ধ্রে দুর্নীতি। ইয়েমেন যুদ্ধে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছে, ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ হয়েছে ঘরহারা। আরও হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছে অপুষ্টিতে ও রোগে ভুগে। আহমেদ বাঘিলি নামে একটি মেয়েকে যখন ইয়েমেনের হোডাইডা শহরের আল থাওরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তখন ১৮ বছরের মেয়েটির ওজন ছিল মাত্র ১১ কেজি। সহজে চোখ খোলা রাখতে পারত না সে। দাঁড়াতেও পারত না। অথচ সেই দেশেই যুদ্ধের জন্যে কেনা হয় কোটি-কোটি ডলারের অস্ত্র। তাতেও পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়মিত সৌদি আরবকে গোয়েন্দা তথ্য ও জেট বিমানের জ্বালানি সরবরাহ করে আসছে। এসব তথ্য ব্যবহার করে ইয়েমেনে বিমান হামলা চালাচ্ছে সৌদি আরব, উঠেছে এমন অভিযোগও। কিন্তু দুর্নীতি কমবে কবে, মানুষ একটু শ্বাস নেবে কবে? জানে না কেউ।

এরপর আফগানিস্তান ! সারা দেশটাই দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ আর সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর হয়ে রয়েছে। মানুষের সামান্যতম মৌলিক অধিকারও আজ সে দেশে নেই। আফগানিস্তানে লাগামছাড়াভাবে বাড়ছে দুর্নীতি। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন বলছে, আফগানিস্তানে প্রতি বছর আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলার দুর্নীতি হচ্ছে, যা দেশটির আফিম বাণিজ্যের প্রায় সমপরিমাণ। আফগানরা ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের চেয়েও দুর্নীতি নিয়ে বেশি চিন্তিত। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বলছে, বিশ্বের দরিদ্রতম মানুষগুলো করের মতন ঘুষ দিয়ে আরেও পঙ্গু হচ্ছে সে দেশে। তালিবানি শক্তি আর সরকারের দিশাহীনতা, আফগান মানুষদের সুখ-শান্তি কবে ফিরবে, তা বলা কঠিন। আমেরিকার নিদারুণ ‘দাদাগিরির’ও শিকার রুগ্ন আফগানিস্তান।

Leave a comment